১ মে ১৯৭১: ‘বাংলাদেশ এখন একটি চিরন্তন সত্য ও বাস্তবতা’ ভারতীয় শিল্পমন্ত্রী
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পয়লা মে ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন ব্রিটিশ বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষ থেকে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সফর শেষে ব্রিটিশ এমপি ব্রুস ডগলাসম্যান শরণার্থী শিবির ও তার সফর নিয়ে দ্য সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দেন। ঢাকায় এদিন সামরিক কর্তৃপক্ষ আরেকটি বিশেষ নোটিশ জারি করে।
ঢাকায় পাকিস্তান সরকার ও সামরিক কর্তৃপক্ষের বিবৃতি
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ নগরীর রেললাইন ও সড়ক পাশের অননুমোদিত বাড়িঘর ও বস্তি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়।
পাকিস্তান সরকার এদিন এক বিবৃতিতে বলে, ‘কিছু সংখ্যক লোক সমাজ-বিরোধীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ভারত উদ্বাস্তুর ধুঁয়া তুলে ব্যবসা করছে।’
১ মে পাকিস্তানের তথ্য দপ্তর জানায়, সরকার বিশেষ কয়েকজন সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সংবাদ প্রকাশের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ঢোকার অনুমতি দেবে। তবে যাদের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো, তারা আর এই অনুমতি পাবেন না।
অন্যদিকে, এদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঢাকা এবং কলকাতায় ভারত ও পাকিস্তানের মিশন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হওয়ায় দুই দেশের দূতাবাসের কর্মীদের রুশ বিমানে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। দুই দেশ সানন্দে সেই প্রস্তাব মেনে নেয়।
বিদেশি সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধ
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘প্রাভদা’ এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়, ধর্ষণ ও মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
পয়লা মে প্রকাশিত এই উপ-সম্পাদকীয়তে লেখা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সামরিক প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ নিন্দাজনক। যা ভবিষ্যতে পাকিস্তানের জন্য ভালো হবে না। কেবল তাই নয়, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যদি নিজেদের এমন অনড় সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তবে তা কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই না, ভারত, এশিয়া, সর্বোপরি বিশ্বের জন্য ভীষণ বিপজ্জনক।
বিদেশি রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিদের বিবৃতি
পয়লা মে ব্রিটিশ বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসনের অন্যতম পার্লামেন্টারি প্রাইভেট সেক্রেটারি ফ্র্যাঙ্ক জাড পাকিস্তানকে সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের কাছে একটি চিঠি প্রদান করেন।
১ মে পশ্চিমবঙ্গ সফর শেষে লন্ডনে ফিরে এসে ব্রিটিশ এমপি হাউজ অব কমন্সের সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান দ্য সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পর মুক্তাঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। আমি যে তথ্য সংগ্রহ করেছি সে সম্পর্কে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি এন্থনি রয়ালের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। পূর্ববঙ্গের সঙ্কট পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয়। এ বিষয়ে আমরা শিগগির ব্যবস্থা নেব।
১ মে ভারতের শিল্পমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী ত্রিপুরার আগরতলার শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি চিরন্তন সত্য ও বাস্তবতা। এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। বাঙালী শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই। পাকিস্তানীদের উচিৎ বাস্তবতা মেনে নেওয়া। বিশ্ববাসীর উচিৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করা।
মুসলিম লীগের প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান এদিন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি তুলে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখজনক পরিস্থিতির উদাহরণ সামনে রেখে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলে এ ধরনের অবস্থা আর সৃষ্টি হবে না। এটাই হচ্ছে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উপযুক্ত সময়।’
এদিন মার্কিন সিনেটে সিনেটর জে ডব্লিউ ফুলব্রাইট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর নীরব থাকা মানে পাকিস্তানি বর্বরতাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করা। পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা না করে এবং এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা তথ্য গোপন রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গণহত্যা নির্যাতনকে সমর্থন করছে।
ইংল্যান্ডে পাকিস্তানী জাতীয় ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
পয়লা মে ইংল্যান্ডের উরস্টার শহরে পাকিস্তানি জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম ম্যাচের বিরুদ্ধে প্রায় ছয়শ প্রবাসী বাঙালী শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এসময় বিক্ষোভকারী বাঙালিদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘হত্যাকারী খুনিরা ফিরে যাও’, ‘গণহত্যা অবিলম্বে বন্ধ করো’, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘খুনি ইয়াহিয়ার নিপাত চাই’-সহ নানা ধরনের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড।
দেশের বাইরে সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা
১ মে ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা অক্সফাম ও ওয়ার অন ওয়ান্ট ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জরুরি চিকিৎসা, খাদ্য ও কাপড়ের জন্য অর্থ সাহায্যের আবেদন জানায়।
এদিন ভারতের এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের যে সমস্ত শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে এবং আটকে আছে তাদের জন্য এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। অন্যদিকে, আরেক বিজ্ঞপ্তিতে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় বলে, বাংলাদেশ থেকে আগত বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।
দেশব্যাপী গণহত্যা, প্রতিরোধ যুদ্ধ
১ মে মেজর শফিউল্লাহ’র নির্দেশে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোরশেদ খান এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে সিলেটের তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর হয়ে শাহবাজপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর আক্রমণের জন্য রওয়ানা হন।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পয়লা মে চট্টগ্রামের রামগড়ের আশেপাশের এলাকার ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। হানাদারদের একটি দল মূল সড়ক ধরে ও অন্য একটি দল রামগড়ের পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হয়।
কুমিল্লার বগাদিয়া সেতুর কাছে নায়েক সিরাজ এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ওপর এমবুশ করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি জীপসহ তিনটি ট্রাক কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল বিক্রমে আক্রমণ চালায়। বগাদিয়ার যুদ্ধে ১৫-২০ জন পাকিস্তানী হানাদার নিহত হয়।
১ মে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পুনরায় কুমিল্লার বড়কামতা আক্রমণ করে এবং গ্রামে ঢুকে গান পাউডার দিয়ে বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
ময়মনসিংহ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক সদস্য সৈয়দ বদরুজ্জামান এদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য ময়মনসিংহবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগ এখন দেশের শত্রু। ভারতের দালালী করে এরা পাকিস্তানকে ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। তারা কখনোই সফলকাম হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনোই তাদের সেই দিবাস্বপ্ন পূরণ হতে দিবে না।’
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ মে ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ২ মে ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক
আরও পড়ুন:
২৭ এপ্রিল ১৯৭১: কালীগঞ্জে গণহত্যা, ইপিআরের নাম পাল্টে ইপিসিএফ
১১ এপ্রিল, ১৯৭১: দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের
১০ এপ্রিল: মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস
Comments