অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় ওমান: প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিস্ময়, ক্ষোভ, ভোগান্তি

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সবশেষ সিদ্ধান্তে বিশ্বের ১২টি ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের নাম আছে। ফলে দেশটি থেকে কোনো স্থায়ী প্রবাসী দেশে ফিরতে পারবেন না। এমন সিদ্ধান্তে হতবাকের সঙ্গে ভোগান্তিতে পড়েছেন ঈদের ছুটিতে দেশমুখী শত শত প্রবাসী। বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। ক্ষোভ জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি কমিউনিটি সংগঠকদের।
গত শনিবার রাতে ওমানের মাস্কাট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশে ফিরতে না পারা প্রবাসীরা। ছবি: স্টার

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সবশেষ সিদ্ধান্তে বিশ্বের ১২টি ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের নাম আছে। ফলে দেশটি থেকে কোনো স্থায়ী প্রবাসী দেশে ফিরতে পারবেন না। এমন সিদ্ধান্তে হতবাকের সঙ্গে ভোগান্তিতে পড়েছেন ঈদের ছুটিতে দেশমুখী শত শত প্রবাসী। বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। ক্ষোভ জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি কমিউনিটি সংগঠকদের।

তাদের মতে, ওমান কোনো অবস্থাতেই অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় আসতে পারে না। গত কিছুদিন ধরে আক্রান্তের হার সামান্য বাড়লেও তালিকার অন্য দেশগুলো মতো নিয়ন্ত্রণহীন নয়। তাছাড়া এই মুহূর্তে বিশ্বের কোনো দেশের অতি ঝুঁকির তালিকায় ওমান নেই।

নতুন নির্দেশনার বেড়াজালে গত শনিবার রাতে ওমানের মাস্কাট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকাগামী দুটি বিশেষ ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে প্রায় ২০০ যাত্রী, যাদের মধ্যে দেশটির দূর-দূরান্তের অনেক যাত্রীও ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে যাত্রার কয়েক ঘণ্টা আগে হঠাৎ করে দেওয়া বেবিচকের নতুন নির্দেশনার কথা কারো জানা ছিল না তাদের।

গত শনিবার থেকে শর্ত সাপেক্ষে আকাশপথে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তবে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি দেশে চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ শর্ত দেওয়া হয়েছে।

বেবিচকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে, 'এ' গ্রুপে অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (জিসিসি) ৬ টি দেশের মধ্যে এমনকি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ছাড়া শুধু ওমানই আছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ওমান থেকে কেউ সরাসরি বা অন্য কোনো দেশে ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারবেন না। তবে প্রবাসী বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে যারা গত ১৫ দিনের মধ্যে ওমানসহ ১২টি দেশের কোনোটিতে ভিজিটে গিয়েছেন, তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন এবং সরকার অনুমোদিত হোটেলে নিজ খরচে বাধ্যতামূলক ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে৷

ওমানের পাশের দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সি ক্যাটাগরিতে থাকায় এবং জিসিসির বাকি তিন দেশ কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীদের দেশে আসার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ওমানে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮০৭ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২০৪৩ জন, সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩৩ জন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্তের হার বাড়লেও তেমন তীব্র নয়, নতুন ভেরিয়েন্টের প্রকোপ তেমন দেখা দেয়নি।

প্রবাসী ব্যবসায়ী সোহারের মো. আর এইচ রবিউল বলেন, ‘২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৩ দিনে ৯২৭ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। অথচ এর চেয়েও বেশি আক্রান্তের দেশকে প্রবেশের সঙ্গে হোম কোয়ারেন্টিনের সুযোগও দেওয়া হয়েছে। ওমানপ্রবাসীদের সঙ্গে এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কেন?’

সরকার নিবন্ধিত বাংলাদেশ সোশ্যাল ক্লাবের সভাপতি সিরাজুল হক বলেন, ওমানের করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এখানকার  অফিস, আদালত, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রয়েছে। শুধুমাত্র রাত ৯ থেকে ভোর ৪ টা পর্যন্ত লকডাউন থাকে। কোন বিবেচনায়, কিসের ভিত্তিতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় ওমান এলো তা আমাদের বোধগম্য নয়।’

শনিবার রাতে মাস্কাট থেকে ঢাকাগামী ওমান এয়ারের স্থগিত করা ফ্লাইটে ৩৮ জন এবং সালামএয়ারের ১৪২ জন প্রবাসী ছিলেন বলে জানা গেছে। তারা সবাই ছিলেন ঈদের ছুটিতে দেশের পথের প্রবাসী। মুঠোফোনে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে।

তারা জানান, এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। আগাম কোন খবরও পাননি। বিমানবন্দরে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয় সবাইকে।

সালামএয়ারের যাত্রী কুমিল্লার সিহাব উদ্দিন বলেন, ৩ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছে ৭৫ রিয়ালে তিন দিনের হোটেল বুকিং করি। এরপর সাড়ে ১০টার সময় যখন বোর্ডিং লাইনে দাঁড়াই তখন জানানো হয় ফ্লাইট বাতিল। বিমানসংস্থার কর্মীরা জানান, আমাদের নাকি বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি নেই। কিছুক্ষণ আগেই তারা নোটিশ পেয়েছে।’ 

চট্টগ্রামের মো. মাসুদ বলেন, ‘করোনাকালে কম বেতন থেকে অনেকে কষ্টে টাকা জমিয়ে ২০০ রিয়ালে টিকিট, করোনা পরীক্ষা আর হোটেলে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করেছিলাম। ২ বছর পর ফিরছি। দেশে পরিবার অপেক্ষায়। যেতে পারলাম না, এখন টাকা ফেরত পাবো কিনা তাও জানি না। বুঝলাম না আমাদের অপরাধটা কী যে এমন শাস্তি দিলো নিজের দেশেই।’

ফ্লাইট বাতিলে শহরের যাত্রীরা ঘরে ফিরতে পারলেও দূরের যাত্রীদের বিমানবন্দরেই রাত কাটাতে হয়। সামান্য খাবারে সেহেরি সারেন সবাই। রাজধানী থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরের সালালার প্রবাসী নোয়াখালীর ফায়াজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাহমাতুল্লাহ, ফেনীর লিটন জানান, বিমানসংস্থা তাদের এখন আবার সালালাহ ফিরে যেতে বলেছে। ফেরার সুযোগ দিতে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।

ওমানকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চট্টগ্রাম সমিতি ওমানের সভাপতি ইয়াসিন চৌধুরী বলেন, ‘ভারত-ব্রাজিলের পরিস্থিতির ধারে কাছেও না থেকে ওমানকে তালিকায় নেওয়া কল্পনাপ্রসূত ও হঠকারী সিদ্ধান্ত বলেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা মনে করছেন। তাছাড়া কোনো সময় না দিয়ে হুট করে এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে করোনাকালে প্রবাসীদের চরম ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তায় ফেলাটাও অমানবিক। কাজেই এ বিষয়ে দ্রুত পুনর্বিবেচনা জরুরি।’

ওমান বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘এমন মনগড়া সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আমরা পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এটি শুধু প্রবাসীদের ভোগান্তিই বাড়াবে না, তাদের মধ্যে সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবও দেখা দেবে।’

সালামএয়ারের ঢাকা অফিস সূত্রে জানা গেছে, মাস্কাট থেকে গতরাতের ফ্লাইটটি যাত্রী ছাড়াই আজ সকালে ঢাকায় পৌঁছে এবং এখান থেকে সৌদি আরবের ৪৯ জন ট্রানজিট যাত্রী নিয়ে রওনা হয়। অন্যদিকে জিএসএ সূত্র জানা গেছে, ওমান এয়ারের ফ্লাইটটি ৫০ জন ট্রানজিট যাত্রী নিয়ে ঢাকা আসে এবং এখান থেকে আমিরাত ও  সৌদিগামী  ১৫০ বেশির যাত্রী নিয়ে ফেরত যায়। বেবিচকের নতুন সিদ্ধান্তে এই রুটে অনুমতি পাওয়া ৫ বিশেষ ফ্লাইট চালাবে কিনা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে সালামএয়ার। ওমান এয়ার ট্রানজিট যাত্রীর জন্য ৩ টি বিশেষ ফ্লাইট অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে। 

গত ২৪ এপ্রিল থেকে ভারত, পাকিস্তানে সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ওমান। এখন দুই দেশেই বাংলাদেশিদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করায় আগামী ১৫ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে বলে ওমান অফিস সূত্রে জানা গেছে। একই  কারণে ইউএস বাংলাও মাস্কাটে রুটে তাদের বিশেষ ফ্লাইটগুলো স্থগিত করেছে।

এজাজ মাহমুদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago