মমতার সাফল্য এবং বাম বিপর্যয় প্রসঙ্গে
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে হবে— এই মানসিকতা দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর চেপে বসবার পর, তাদের মরিয়া আচরণই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় ফিরে আসার অন্যতম কারণ হয়ে উঠল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একটি অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা দখলকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদম ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে নিচ্ছেন, এই ছবি ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কখনো দেখা যায়নি। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলকে ব্যক্তিগত ইস্যু করে নিয়েছিলেন, সেটিই প্রচারপর্বে মানুষের কাছে তুলে ধরে তাদের একটা বিশেষ অনুভূতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন মমতা। খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে (যিনি একজন নারী) প্রকাশ্যে ব্যঙ্গাত্মকভাবে সম্বোধন করছেন, এটাকে রুচি এবং সংস্কৃতিবিরোধী বলেই মনে করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। সেই মনে করা থেকেই তারা দুহাত তুলে ভোট দিয়েছেন মমতাকে।
উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উন্মেষকালে গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন, ‘বাংলা আজ যা ভাবে, গোটা ভারত কাল তাই ভাবে।’ সেই আপ্তবাক্য মাথায় রেখেই কি মোদি মনে করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি শাসন কায়েম করতে পারলে এনআরসি, কৃষি আইন সংশোধনীর মতো বিষয়গুলো সহজে অতিক্রম করে তিনি দুবছর পর উত্তরপ্রদেশে বিজেপির সাফল্য এনে দিতে পারবেন? আর দুবছর পরে উত্তরপ্রদেশের ভোটে বিজেপি জিতলেই আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির জেতা খুব সহজ হবে?
মমতাকে হারানোটা একদম নিজের ব্যক্তিগত মর্যাদার বিষয় করে তুলেছিলেন মোদি-শাহ। সেই কারণেই কি মমতার সমর্থকদের ভেতর নানা বিষয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, সেগুলো ভুলে তারা মমতাকে জেতাতে দৃঢ় সংকল্প হয়? সাধারণ মানুষের ভেতরে যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হয়েছিল, খোদ প্রধানমন্ত্রীর মমতাকে তির্যক আক্রমণকে ঘিরে সাধারণ মানুষের ভেতর এতোটাই প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় যে, পেশাদার সংস্থার দ্বারা তৈরি ‘বাংলার নিজের মেয়ে’ শ্লোগানটি সব রকমের ক্ষোভ-দুঃখকে অতিক্রম করে মমতার প্রতি একটা আবেগ-সহানুভূতির পরিমণ্ডল তৈরি করে? এই পরিমণ্ডলই মমতাকে এতোখানি সাফল্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে?
আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) আদর্শগতভাবে যতোই ধর্মনিরপেক্ষ হোক না কেন, একটা বড় অংশের বামপন্থী কর্মী ও সমর্থকদের ভেতর দীর্ঘদিন ধরে যে সুপ্ত মুসলিম বিদ্বেষ ছিল, সেটি এই জোটকে ঘিরে উসকে উঠেছিল? গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশে তাদেরই এক শরিক নেতা আব্বাস সিদ্দিকি বক্তৃতা শুরু করা মাত্রই নিজের সাম্প্রদায়িক অবস্থান সহযোদ্ধা মহলে বলে ফেলেন। এই ঘটনা বর্তমান নিবন্ধকারের সামনেই ঘটে। ঘটনাটি নিবন্ধকার যখন সিপিআই (এম) এর এক শীর্ষ নেতাকে বলেন, তখন সেই নেতা বলেছিলেন, ‘আমাদের ভেতর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক বা বিজেপি মানসিকতার লোকদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আইএসএফ-আব্বাস কার্যত ছাকনির কাজ করবে।’
ভোটের ফল থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, বামপন্থীদের ভেতর মুখে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা একটা বড় অংশের মানুষ মানসিকভাবে ভয়ঙ্কর রকমের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকদের পছন্দ করে, নতুবা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকদের পছন্দ করে। নিজেদের সংযুক্ত মোর্চাকে ভোট না দিয়ে তারা হয় বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, নতুবা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। আইএসএফ মানেই আব্বাস সিদ্দিকি, আর আব্বাস সিদ্দিকি মানেই মুসলমান, এই মেরুকরণের ভিত্তিতেই একটা বড় অংশের মানুষ, যারা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করে, বামপন্থীদের মিটিং মিছিলে যায়, তারা ভোট দেয়নি বামপন্থীদের।
মাত্র তিন চার মাস আগে রাজনীতির ময়দানে এসে আব্বাস বা তার দল যে ধর্মীয়, ভাষাভিত্তিক, তফসিলি জাতি-উপজাতিভুক্ত মানুষদের ওপর তেমন কিছু প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি, ভোটের ফল থেকে তা পরিষ্কার। যে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করা হয়েছে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এবং সেই মোর্চার অন্যতম শরিক কংগ্রেস, আইএসএফের সঙ্গে আসন সমঝোতা ঘিরে অহেতুক সময় নষ্ট করেছে, সেই আইএসএফ মমতার ধারাবাহিক কর্মপদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে সেই ভোটে থাবা বসাতে পারবে মাত্র তিন-চার মাসে, এটা খানিকটা কষ্ট-কল্পনা গোছেরই হয়ে গেছে।
আব্বাস সিদ্দিকি পবিত্র ফুরফুরা তরিকার মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের ওপর আব্বাসের সার্বিক প্রভাব থাকার কথা নয়। সেই প্রভাব তৈরি করতে হলে আব্বাসকে ন্যুনতম দুই থেকে তিন বছর সময় দিতে হতো। একইভাবে একজন পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষকে নেতৃত্বে তুলে আনার ধারাবাহিক পদ্ধতি সম্পর্কে যে বুদ্ধিমত্তা এবং বাস্তববোধের প্রয়োজন, তা বামপন্থীদের ভেতর মহম্মদ সেলিম ছাড়া আর কারও নেই। সেলিমকে এই ব্যাপারে খোলা মনে ছাড়পত্র কেবল তার দল নয়, গোটা বামফ্রন্ট কি দিয়েছিল? যদি দিতো তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ‘ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ে’ প্রবাদবাক্যের মতো এই রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কাজটি দুই-তিন মাস আগে শুরু করতেন না। সেলিমের মতো দূরদর্শী নেতা সেটা শুরু করতেন কয়েকবছর আগে থেকে।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে নিজের দলের আংশিক বিপর্যয়ের পর পেশাদার সংস্থার (প্রশান্ত কিশোরের) সাহায্য নিয়ে যেভাবে ক্ষত নিরাময়ে আত্মনিয়োগ করেছিলেন মমতা, তার সুফল তিনি ভোটে পেয়েছেন। বামপন্থীরা ২০১১ সাল থেকে ক্ষত নিরাময়ে দলীয় রেজিমেন্টশনের বাইরে কিছু ভাবতেই পারেনি। আর দলীয় রেজিমেন্টশনের ক্ষেত্রেও তারা এতো বেশি গোষ্ঠী রাজনীতির দ্বারা ক্ষমতাচ্যুতির ১০ বছর পরেও সংক্রমিত যে, মুক্তমনে নিজের কুয়োর বাইরে কোনো কিছুকে গ্রহণ করতে তারা প্রস্তুত কি না, তা নিয়েই সংশয় আছে।
মমতা যে পপুলিস্ট রাজনীতির ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছু সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার রাস্তায় হেঁটেছেন, সেটা তার এই নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম টিআরপি। অপরদিকে, মানুষকে সাময়িক সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার এবং তার অর্থমন্ত্রী ড. অশোক মিত্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটি পরবর্তী সময়ের অর্থমন্ত্রী ড. অসীম দাশগুপ্তের ভেতরে দেখা যায়নি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর ড. দাশগুপ্ত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন অনেক বেশি। ফলে সাধারণ মানুষের সাময়িক পরিত্রাণ পাওয়ার ক্ষেত্রটি অনেক সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল। এই জায়গাটি মমতা প্রথম থেকেই একটা জনপ্রিয়তার লেবাস দিয়ে ধরেছেন। ফলে একটা নতুন কারখানা তৈরি না হলেও নানা ভাতা, উৎসবের ভেতর দিয়ে গরিব মানুষ নগদ কিছু টাকা পেয়েছেন। শিক্ষা ব্যবস্থাতে যে বেসরকারিকরণ বাজার অর্থনীতির জেরে চালু হয়েছিল বাম আমলেই, মমতা সেটাকে লাগামহীন করেছেন। মধ্যবিত্ত এর ফলে মেধাকে পয়সার জোরে কিনতে সক্ষম হয়েছে আগের থেকে অনেক বেশি। মধ্যবিত্তের এই পয়সার মাধ্যমে মেধা কেনার তাগিদে রাজ্যের শ্রমের বাজারে তৈরি হয়েছে শূন্যতা। গরিব মানুষ এসেছে সেই শূন্যতা ভরাট করতে। আর কন্যাশ্রী, যুবশ্রী ইত্যাদি ভাতার ভেতর দিয়ে এই গরিব মানুষদের ভেতর নিজের প্রভাবকে স্থায়ী করেছেন মমতা। তাই বামপন্থীদের সভা-সমিতিতে ভিড় করলেও তারা বামপন্থীদের ভোট দেয়নি, দিয়েছে তৃণমূলকে আর কিছুটা বিজেপিকে। বিজেপি দৈনিক ভাতা দিয়ে ভোটের সময় কর্মী নিয়োগ করে প্রচার কাজ করেছে। আর সেই টাকার বিনিময়ে বিজেপির হয়ে খাটা কর্মীরা মমতার প্রশাসনের দেওয়া নানা ভাতার তাগিদে ভোটটা দিয়েছে মমতাকেই।
অপর দলের জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে নেতা-কর্মীদের নিজের দলে শামিল করার বিষয়টির সূচনা করেছিলেন মমতা। বিজেপি সেটিকে সফলভাবে অনুকরণ করেছে। মমতার অন্য দল থেকে ভাগিয়ে আনা নেতারা (যেমন: মানস ভুঁইয়া, উদয়ন গুহ) কম-বেশি ভোট রাজনীতিতে সফল হলেও, বিজেপিতে গত তিন-চার মাসের ভেতরে যারা তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে যোগ দিয়েছেন, (যেমন: সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ডোমজুরের রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ) তারা এবারের ভোটে মানুষের দ্বারা চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এইসব নেতাদের মানুষের দ্বারা প্রত্যাখ্যান আজ ও বাঙালির নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা পরিচয় হিসেবেই উঠে আসছে।
গৌতম রায়: ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments