জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামীর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
Nirmul_Commity.jpg
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামীর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব বানচালের উদ্দেশ্যে হেফাজত-জামায়াতের দেশব্যাপী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে- জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার নাগরিক আন্দোলন এখনো কতোটা জরুরি।’

শহীদজননী জাহানারা ইমামের ৯২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে তিনি একথা কথা বলেন।

আজ সোমবার বিকাল ৩টায় ‘সকল কওমি মাদ্রাসা সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে’ শীর্ষক ওই ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।

এসময় শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বিলম্বে হলেও সরকার বর্তমানে হেফাজতের জঙ্গি নেতাদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে, যা অভিনন্দনযোগ্য। তবে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসের বিষবৃক্ষ জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূল করা যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘জামায়াত-হেফাজতিরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো জঙ্গি-মৌলবাদী-সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাবার জন্য কওমি মাদ্রাসার নিরীহ ছাত্রদের ব্যবহার করছে। পঁচিশ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসার তিরিশ লক্ষাধিক ছাত্র-শিক্ষককে আমরা জামায়াত-হেফাজতের সন্ত্রাসী রাজনীতিক অভিলাষ পূরণের জন্য তাদের কাছে জিম্মি রাখতে পারি না।’

‘হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসায় সরকারের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে পৃথক পৃথক আলিয়া-কওমি-নূরানি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন নেই। সব মাদ্রাসায় একই পাঠ্যসূচি প্রচলন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-চেতনা, জাতির পিতার জীবনী, বাংলাদেশের সংবিধান, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন সব মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলক করতে হবে’, যোগ করেন তিনি।

নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘জামায়াত-হেফাজতের একমাত্র উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া ও বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করা। হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসায় বিপুল সংখ্যক জঙ্গিরা এজন্য প্রস্তুত আছে বলে আমরা জানি। কিন্তু তারা ৩০ লাখ শহীদ ও প্রায় সোয়া ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে আমরা তা মেনে নেব না।’

তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসার ছাত্ররা পাকিস্তানি ভাবধারায় গড়ে উঠছে। শিক্ষার মূলধারায় তাদের আনতে হবে। আমার প্রস্তাব বর্তমানে অন্তর্ভুক্ত “বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়” বিষয়টির নাম রাখা হোক “বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ”। উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতার সুযোগ থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বহু বছর আন্দোলন করেছি। এখন আন্দোলনে নামতে চাই, দেশবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার করতে হবে।’

নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কাজ ১৯৭৫ সালের পর পরিবর্তন হয়ে যায়। মাদ্রাসায় শিক্ষা সরকারের সুবিধাপুষ্ট, কিন্তু তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তারা কী পড়াচ্ছে, কী শেখাচ্ছে তা আমরা জানি না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের জন্য যা কাম্য নয়।’

তিনি বলেন, ‘এসব মাদ্রাসায় আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার ছিটেফোঁটাও নেই। আমরা মৌলবাদের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরে আর ফিরে তাকানোর সময় পাব না। কওমি মাদ্রাসার সনদকে এমএ ডিগ্রির সমান কীভাবে করা হলো, কাদের ইন্ধনে করা হলো, তা আমাদের বোধগম্য নয়। অবশ্যই কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’

নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শিক্ষাবিদ কলাম লেখক মমতাজ লতিফ বলেন, ‘এখনই সময় ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। শিক্ষামন্ত্রীকে বলছি, লাখ লাখ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় এনে তাদের রক্ষা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মতো। এরকম এ দেশে করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতার বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। এখনই এ কাজে হাত দিতে হবে। মাদ্রাসাগুলোতে জঙ্গিরা প্রস্তুত হয়ে আছে সরকার পতনের জন্য, বাবুনগরীকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য। বাবুনগরী থেকে শুরু করে সব মৌলবাদী নেতৃত্বকে অপরাধের শাস্তি দিতে হবে। সুশীল সমাজসহ সবাইকে এজন্য আন্দোলন করতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক, সংস্কৃতিমনস্ক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অবশ্যই মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’

নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘শহীদজননী জাহানারা ইমামের উৎসাহে আমি লেখালেখিতে যুক্ত হয়েছিলাম। প্রকৃতপক্ষে হেফাজত রাজনৈতিক দল। সুযোগ পেলেই তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী আছে। এই কর্মীবাহিনীরা হচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্র, যাদের লেখাপড়া করার কথা। কিন্তু লেখাপড়ার বাইরে গিয়ে কওমি মাদ্রাসায় তারা ধর্মান্ধ, মৌলবাদী হিসেবে গড়ে ওঠে। এজন্য আমরা দায়ী।’

তিনি বলেন, ‘বাবা-মা দরিদ্রতার কারণে তাদেরকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিচ্ছে। তাদের সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা আমরা করে দিতে পারছি না। বাবা-মাকে যেন মাদ্রাসায় সন্তানকে পাঠাতে না হয়- সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হোস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে। খবরের কাগজে মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতনের খবর পড়ে আমার খুব কষ্ট লেগেছে। এসব থেকে পরিত্রাণে জন্য বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।’

বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে “দালাল আইন” বাতিল করার পর শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির বিষয়ে আমারা কোরান, হাদীসের বিধিবিধান প্রচার করেছি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কোরআন অনুযায়ী “হেফাজতে ইসলাম” নামটি পরিপন্থী। কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষক ছাত্রের বৈষম্য প্রকট। কওমি মাদ্রাসায় মানবতার শিক্ষা, দেশপ্রেমের শিক্ষা দেওয়া হয় না। জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে কোনো মাদ্রাসায় এখন পর্যন্ত একটি চিঠিও যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন- বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি যাদের আনুগত্য নেই, তাদেরকে আমরা কেন স্বীকৃতি দিলাম? মাদ্রাসাগুলোতে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যে সম্বন্ধে ইসলামে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। শিক্ষামন্ত্রীকে আহ্বান জানাই, অবিলম্বে কওমি মাদ্রাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমিক মানবতাবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে তুলতে হবে। হেফাজতের অপরাধের অবশ্যই বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।’

শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি বলেন, আমরা যখন কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন ও ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করছি, তখন কওমি মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের জাতিবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী গুজবের কারখানা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় না জিহাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা সম্বন্ধে বাবা-মাকে জানাতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

সভার অন্যান্য বক্তা নতুন শিক্ষানীতিতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাভিত্তিক পাঠক্রম বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান।

এর আগে, আজ সকাল ৮টায় মিরপুরে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় ও মহানগরের নেতারা।

Comments

The Daily Star  | English
Gross FDI Flow to Bangladesh

Uncertainty shrouds business recovery

The uphill battle to restore confidence among the business community is progressing slowly as the Prof Muhammad Yunus-led interim government marks its second month in office.

14h ago