‘কখনো ভাবিনি আমাকে গুম করা হবে’

‘আমার এখনও এটি বলার সাহস নেই যে আমাকে কি জোর করে গুম করা হয়েছিল, নাকি আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম,’ ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল গতকাল সোমবার এক ওয়েবিনারে এ কথা বলেন।
শফিকুল ইসলাম কাজল। ছবি: সংগৃহীত

‘আমার এখনও এটি বলার সাহস নেই যে আমাকে কি জোর করে গুম করা হয়েছিল, নাকি আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম,’ ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল গতকাল সোমবার এক ওয়েবিনারে এ কথা বলেন।

৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর কাজলকে গত বছরের ৩ মে ভারতের সীমান্তবর্তী বেনাপোলে ‘খুঁজে পাওয়া’ যায়।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ‘নাগরিক’ আয়োজিত ওয়েবিনারে তিনি বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে আমি আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম। কিন্তু, কখনোই ভাবিনি যে আমাকে গুম করা হবে।’

‘কীভাবে আমি ও আমার পরিবার সেই নিষ্ঠুর সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি— তা বলা সম্ভব না।’

তিনি বলেন, কখনো পরিচিতজনদের মাঝে ফিরতে পারবো, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারব এটা ভাবিনি।

তিনি বলেন, ‘ফিরে আসতে সহায়তা করবে এ বিষয়ে আমার নিজের কোনো ক্ষমতা বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল না।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

তিনি বলেন, ‘কাজল আমাদের জানিয়েছিলেন যে তাকে যখন ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে বেনাপোলে পাওয়া যায়, তখন তার পাসপোর্টে বৈধ ভারতীয় ভিসা ছিল। এ থেকে প্রশ্ন জাগে যে কেন তিনি বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও বিনা পাসপোর্টে ভারতে যাবেন?’

অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার জানান, গত বছর নভেম্বরে গুম করা হয়েছিল তাকে। তিনি জানান, কীভাবে তাকে সারাক্ষণ প্রাণভয়ে থাকতে হতো এবং এক পর্যায়ে তিনি তার চট্টগ্রামের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হন।’

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এ মুহূর্তে সরোয়ারের জন্য সাংবাদিকতা করার চেয়ে বেঁচে থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

সরোয়ার বলেন, ‘আমি কীভাবে গত ছয়টি মাস কাটিয়েছি তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। আমাকে গাড়ি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আমি দুই বার মারাত্মক আহত হই। শেষ বারের প্রচেষ্টায় আমার পায়ের আঙুলের নখ ভেঙে গিয়েছিল। এরপরই আমি গ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি কাজলের কষ্ট বুঝতে পারি। আমি শুধু এটুকুই বলব, আমাকে সংবাদ ছাপানোর কারণে অপহরণ করা হয়েছিল। যখন আমার ওপর অত্যাচার চালানো হচ্ছিল, তখন আমার অপহরণকারীরা ফোনে নির্দেশ পান। তাদেরকে বলা হয়েছিল আমাকে জিজ্ঞাসা করতে যে আমি কি আর সাংবাদিকতা করবো কি না।’

সরোয়ার জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে এবং পুলিশ সেগুলোর তদন্ত করছে।

‘কিন্তু আমাকে অপহরণ করায় আমি কোতোয়ালী থানায় যে মামলা করেছি এর তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখছি না’, যোগ করেন তিনি।

বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ান জানিয়েছেন, তিনিও একই রকম পরিস্থিতিতে আছেন এবং কাজ করতে পারছেন না। বলেন, ‘মানুষ আমাকে অশ্লীল কথা বলেছে এবং নাস্তিকদের সঙ্গে তুলনা করেছে। আমার ফাঁসির দাবিও তুলেছিল।’

তার মতে, গত বছরে গাওয়া একটি গানের কারণে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে নিপীড়ন করা হয়েছে।

‘নিপীড়ন সব সময়ই থাকবে। কিন্তু, আমাদেরকে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে হবে’, বলেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় তিনি কারাভোগ করেছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম দেশে কীভাবে একটি ‘বিকলাঙ্গ ও নিশ্চুপ প্রজন্ম’ তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা বা তাদেরকে গ্রেপ্তার করার মানে হচ্ছে আপনি গণতন্ত্র চান না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সিআর আবরার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে অতি সত্ত্বর বাতিলের প্রস্তাব দেন।

তিনি বলেন, ‘মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন।’

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘মুক্তচিন্তা ছাড়া কোনো কার্যকর ও স্বাধীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব নয়।’

ইতোমধ্যে, আর্টিকেল ১৯ নামের যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন গতকাল সোমবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার শোচনীয় অবস্থার সমালোচনা করেছে।

মানবাধিকারকর্মী সেলিম সামাদের বরাত দিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এখানে কোন গণমাধ্যমই মুক্ত নয় এবং আমাদের দেশে গণমাধ্যমে কর্মরত ব্যক্তিরা তাদের মতামত স্বাধীনভাবে তুলে ধরতে পারেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র বাইরের চাপের কারণে সাংবাদিকরা সত্য লিখতে পারছেন না, ব্যাপারটি এরকম নয়। নিজ প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও তারা সেন্সরশিপের মুখে পড়েন।’

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
quota reform movement,

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of 726 people who died during the student-led mass protests in July and August.

47m ago