স্পিন নিয়ে কি তবে ছিল ফাঁপা আত্মতুষ্টি?

Taijul Islam
শ্রীলঙ্কায় স্পিনারদের এমন উপলক্ষ এলেও তাতে ছিল না ম্যাচের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ কোন মোড়। ছবি: এসএলসি

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের মূল শক্তি বলা হয় স্পিনকে। যথেষ্ট ভালো মানের স্পিনার আছেন, এমনটা ধরে নিয়ে ঘরের মাঠে বানানো হয় অতি স্পিনবান্ধব উইকেট। তাতে কিছু সাফল্য এলেও শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে এবার দেখা গেল ভিন্ন বাস্তবতা। তুলনায় অনেক অভিজ্ঞ বাংলাদেশের স্পিনাররা যেখানে সাদামাটা, সেখানে রাজত্ব করলেন লঙ্কান অনভিজ্ঞ স্পিনাররা। একই উইকেটে লঙ্কানদের দাপট বাংলাদেশের স্পিনারদের সামর্থ্য নিয়ে তুলেছে প্রশ্ন।

এবার লঙ্কা সফরে পাল্লেকেলেতে প্রথম টেস্টের উইকেট ছিল একদমই নিষ্প্রাণ। পরে একটি ডিমেরিট পাওয়া উইকেট থেকে ম্যাচে ফল বের হয়নি। কিন্তু একই ভেন্যুতে দ্বিতীয় টেস্টের উইকেট ছিল শ্রীলঙ্কার চিরায়ত ঘরানার।

প্রথমে ব্যাটসম্যানদের সুবিধা দিলেও সময়ের সঙ্গেই তা দখলে চলে যায় স্পিনারদের। বাংলাদেশকে ২০৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হারাতে একাই ১১ উইকেট নেন অভিষিক্ত বাঁহাতি স্পিনার প্রভিন জয়াবিক্রমা। অভিষেকে কোনো বাঁহাতি স্পিনারের এটাই সেরা বোলিং। অথচ লাসিথ এম্বুলদেনিয়া চোট না পেলে তিনি দলেই আসতে পারতেন না। এমনকি লঙ্কান বাঁহাতি স্পিনারদের তালিকায় তার নাম কদিন আগেও সেরা তিনে ছিল না।  ৬ উইকেট পান দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা রমেশ মেন্ডিস। তিনিও মূলত ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ বাংলাদেশের ২০ উইকেটে ১৭টিই পান এই দুই অনভিজ্ঞ স্পিনার।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের দুই স্পিনার তাইজুল ইসলাম (৩৩ টেস্ট) আর মেহেদী হাসান মিরাজ (২৬ টেস্ট) দুজনেই বেশ অভিজ্ঞ বলা যায়। প্রথম ইনিংসে তারা পেয়েছিলেন একটি করে উইকেট। ওই ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়ে দলের সবচেয়ে সফল পেসার তাসকিন আহমেদ।

দ্বিতীয় ইনিংসে ছিল ভিন্ন পরিস্থিতি। বাংলাদেশকে ফলোঅন না করিয়ে দ্রুত রান বাড়ানোর তাড়া ছিল লঙ্কানদের। তাদের ব্যাটসম্যানরা আগ্রাসী হওয়ার কারণে তাইজুল পান ৫ উইকেট আর মিরাজ ২ উইকেট। উইকেট পান অনিয়মিত স্পিনার সাইফ হাসানও। তবে লঙ্কানদের ধীরে খেলার প্রয়োজনীয়তা থাকলে একটি উইকেটও তারা পেতেন কিনা সন্দেহ! কারণ, উইকেট পাওয়ার মতো তেমন আহামরি বিষ দেখা যায়নি তাদের স্পিনে।

চতুর্থ দিনের পিচেও মিরাজ-তাইজুল আদায় করতে পারেননি প্রত্যাশিত টার্ন। বৈচিত্র্য আর সৃজনশীলতার দিক থেকেও তারা ছিলেন অনুজ্জ্বল।

Praveen Jayawickrama
অভিষেকেই ১১ উইকেট নিয়ে নায়ক বনেন শ্রীলঙ্কান তরুণ প্রাভিন জয়াবিক্রমা। ছবি: এসএলসি

দুই ইনিংসেই দারুণ টার্ন আদায় করতে দেখা যায় লঙ্কান স্পিনারদের। ম্যাচে শ্রীলঙ্কান স্পিনারদের গড় টার্ন ছিল ৪.৯ ডিগ্রি। আর বাংলাদেশের স্পিনারদের ২.৯ ডিগ্রি।

বিসিবির গেম ডেভলপমেন্টের প্রাক্তন কোচ ও বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ক্রিকেট পরামর্শক নাজমুল আবেদিন ফাহিম  গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন দুই দলের স্পিন শক্তি।

মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপে ফাহিম জানান, এই সফর বাংলাদেশের স্পিন শক্তির বাস্তবতা বোঝা গেছে, ‘অনেক জিনিস আসলে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আমাদের স্পিন শক্তি কোন জায়গায় আছে। আমাদের স্পিন শক্তির বিচার কিন্তু কেবল ঘরের মাঠেই দেখেছি। বাইরে গিয়ে কেমন করে সেটা দেখা হয়নি। এবার যেটা হয়েছে, তুলনায় আমাদের বেশ অভিজ্ঞ দুই স্পিনার যে বল করলেন এবং তাদের একদম অনভিজ্ঞ স্পিনাররা যে বল করেছেন, তাতে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের অবস্থানটা কোথায়।’

ফাহিম ব্যাখ্যা করেন, বাংলাদেশের স্পিনারদের কেন দেখিয়েছে এতটা সাদামাটা,  ‘শুধু টার্নের ব্যাপারটাই না, শুধু স্পিনারদের বৈচিত্র্যের ব্যাপারও না বোলিংয়ের সেন্সটাও একটা বিষয় ছিল। ওরা (লঙ্কানরা) জানে ব্যাটসম্যানকে কীভাবে খেলাতে হয়। কীভাবে কোণঠাসা করতে হয়। আমাদের বোলিং দেখে মনে হয়েছে, এটা ল্যাবরেটরিতে শেখা বোলিং। একটা ছকে বাধা বোলিং। কিন্তু ওদেরটা খুব উদ্ভাবনী সম্পন্ন, সৃজনশীল চিন্তার। ওদের জুনিয়র তরুণ এক ছেলের মাঝে যে সৃজনশীলতা আছে, তার মানে হচ্ছে, স্পিন বোলিংয়ের সংস্কৃতিটা আমাদের থেকে ওদের অনেক উন্নত।’

ঘরের মাঠে সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও বাংলাদেশের স্পিনাররা ছিলেন বিবর্ণ। তবে এর আগে দেশের স্পিনারদের আছে বড়াই করার মতো সাফল্য। তার পেছনে ছিল অতি স্পিনবান্ধব উইকেট। যেটাকে ক্রিকেটের ভাষায় বলা হয় ‘র‍্যাঙ্ক টার্নার’।

এসব উইকেটে খেলার কারণে স্পিনারদের ভেতরে একটা ফাঁপা আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে বলে ধরা পড়ে এই অভিজ্ঞ কোচের কথায়, ‘আমাদের সমস্যা হলো, আমরা কোন জায়গাটাতে পৌঁছাতে পারলে সন্তুষ্টিতে ভুগি, সেটাও দেখার বিষয় বোধহয়। কতটুকু অর্জন হলে আমরা সন্তুষ্ট হয়ে যাই, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

‘আমরা মনে হয়, সন্তুষ্ট ছিলাম যে, আমাদের বোলাররা ভাল লাইন-লেংথে বল করতে পারে, একটু বল ঘোরাতে পারে। এটা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু এটা যে যথেষ্ট না, এটা কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেছে।’

‘আমরা যারা স্পিন বোলিং নিয়ে কাজ করি বা যারা বল করে, সবাইকে বুঝতে হবে আমরা যে স্পিন বল করি, সেটা কোনো অবস্থাতেই যথেষ্ট না।’

পাল্লেকেলের উইকেট শেষ দিনে গিয়েও একদম ভেঙে যায়নি। মানসম্পন্ন ব্যাটসম্যানরা সেখান থেকে রান বের করতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশের অতি স্পিনবান্ধব উইকেটে প্রথম দিনেই ব্যাট করা হয়ে যায় দুরূহ। এতেই স্পিনারদের নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে তৈরি হয় ভুল ধারণা।

 

Comments

The Daily Star  | English
public servants not forced to retire

Public servants won’t be forced to retire

The Advisory Council has decided to abolish a provision of the Public Service Act, 2018, which allows the government to send public servants into forced retirement after 25 years of service.

9h ago