বাংলার সংগীত, নাটক, নারী স্বাধীনতার পথিকৃৎ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

তার হাত ধরেই উন্মোচিত হয়েছিল সংস্কৃত নাটকের অনন্য রত্ন ভাণ্ডার। গিরিশচন্দ্র ঘোষের আগে তিনি রঙ্গমঞ্চে বাংলা নাটককে দিয়েছেন প্রাণের ছোঁয়া। আকারমাত্রিক বাংলা স্বরলিপির যে প্রচলন আছে তার স্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
Jyotirindranath Thakur
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তার হাত ধরেই উন্মোচিত হয়েছিল সংস্কৃত নাটকের অনন্য রত্ন ভাণ্ডার। গিরিশচন্দ্র ঘোষের আগে তিনি রঙ্গমঞ্চে বাংলা নাটককে দিয়েছেন প্রাণের ছোঁয়া। আকারমাত্রিক বাংলা স্বরলিপির যে প্রচলন আছে তার স্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

আমরা লালনের যে ছবিটি দেখি তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই আঁকা। শিলাইদহে পদ্মার বোটে বসে লালনের ছবিটি এঁকেছিলেন তিনি৷ বাঙালি যে ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করতে পারে তিনিই তা শিখিয়েছিলেন। বাঙালি প্রথম স্বদেশীয়ানার ছাপ পেয়েছিলো তার মধ্যে। নিজের স্ত্রী কাদম্বরীকে কলকাতার চিৎপুরের রাস্তা দিয়ে ইডেন গার্ডেনসে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনিই প্রথম নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে সচেতন করেছিলেন ভারতবর্ষকে।

Lalon Shah
পদ্মায় বোটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের ছবি

ঠাকুরবাড়ির এই ছেলেটির জন্ম না হলে হয়তো বাঙালির গীতা রহস্যের খোঁজ পাওয়া যেত না।

কিন্তু, তার সবচেয়ে বড় অবদান রবীন্দ্রনাথের সামনে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করা। বারো বছরের অনুজ রবীন্দ্রনাথকে তো তিনিই কোলেপিঠে করে গড়ে তুললেন। তিনি কিংবদন্তি নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা, লেখক, সম্পাদক ও চিত্রশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৪৯ সালের ৪ মে কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মা সারদা সুন্দরী দেবী। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক ও দার্শনিক। বড়ভাই কবি, দার্শনিক সংগীতজ্ঞ ও গণিতজ্ঞ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান। আর প্রথম ভারতীয় আইসিএস অফিসার ছিলেন তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ছোটবেলায় অগ্রজ হেমেন্দ্রনাথ শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। হেমেন্দ্রনাথ শিক্ষক হিসেবে খুব কড়া ছিলেন। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনে সত্যেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথ বিশেষ ছাপ ফেলেছিলেন। তারা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে একদিকে যেমন ব্যায়াম, কুস্তি, সাঁতার শিখতে উৎসাহিত করেন, তেমনই নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, বিজ্ঞানশিক্ষা, ভাষাশিক্ষা ইত্যাদিতেও উৎসাহ দিয়েছিলেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্মের সাত মাস বয়সে দেবেন্দ্রনাথ পরিবারের ২১ সদস্যকে নিয়ে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।  আর তার  ১০ বছর বয়সেই  দেবেন্দ্রনাথ  জোড়াসাঁকো  ঠাকুরবাড়িতে দুর্গোৎসব বন্ধ করে দিলেন। এর আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমাদের সাবেক চণ্ডীমণ্ডপ ব্রহ্মমণ্ডপে পরিণত হল।’

এরপরই গিরীন্দ্রনাথের পরিবার আলাদা হয়ে দ্বারকনাথের বৈঠকখানা বাড়িতে পূজাপাঠের ব্যবস্থা করলেন। দেবেন্দ্রনাথের পরিবার মূল বাড়িতে রয়ে গেলেন।

এরপর সেন্ট পল’স ও মন্টেগু’স স্কুলে পড়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৬৪ সালে হিন্দু স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ফার্স্ট আর্টস পড়তে ভর্তি হন। সেসময় থিয়েটারে আকৃষ্ট হয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেন  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

সামনে বসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাঁড়িয়ে কাদম্বরী দেবী, পেছনে দাঁড়িয়ে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্ঞানদাননন্দিনী দেবী।

নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্র আবিষ্কার

মূলত ছাত্রাবস্থাতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেসময় একটি পারিবারিক নাট্যদল গঠন করে নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করেন মূলত তার জ্ঞাতি ভাই গণেন্দ্রনাথের হাত ধরে ১৮৬৫ সালে স্থাপিত জোড়াসাঁকো নাট্যশালায়।

এই নাট্যশালায় প্রথম যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল, তা হলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই নাটকে অহল্যাদেবী নামে এক সাহসী রানির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। প্রথম জীবনে নাট্যাভিনয়ে সাফল্য তাকে নাট্যকার হওয়ার ব্যাপারে উদ্দীপ্ত করেছিল।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন হিন্দু মেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার অনুপ্রেরণায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছোটবেলায় এতে যুক্ত হয়েছিলেন। একসময়  নবগোপাল মিত্রের অনুরোধে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার লেখা কবিতা আবৃত্তি করা শুরু করলেন। পুরো প্রক্রিয়াটি তার মনে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলেছিল। তখন উদ্দীপ্ত হয়ে  দেশাত্মবোধক নাটক রচনা করতে শুরু করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

এছাড়াও, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রসাত্মক নাটক রচনার রীতি চালু করেছিলেন। ১৮৭৪ সালে তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিদ্বাজন-সমাগম। এই প্রতিষ্ঠানটি রবীন্দ্রনাথকে তার প্রথম দিকের নাটক ও নৃত্যনাট্য প্রদর্শনে সাহায্য করেছিল।

কিঞ্চিৎ জলযোগ, পুরুবিক্রম, সরোজিনী, অশ্রুমতি, স্বপ্নময়ী, হঠাৎ নবাব, অলীক বাবু’র মতো কী দুর্দান্ত নাটকের জন্ম তার হাতে। কেবল নিজে নাট্যকারই ছিলেন না, ছিলেন নাট্য অনুবাদকও। সংস্কৃত, ফরাসি ও ইংরেজি থেকে বহু বিখ্যাত নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৮৭৪ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার কাজে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নিযুক্ত করেন। কলকাতা ছেড়ে তাকে কখনো যেতে হয় কটক, কখনো শিলাইদহে। সেসময় তিনি লিখেছিলেন ‘পুরুবিক্রম’ নাটক। সত্যেন্দ্রনাথের লেখা ‘মিলে সবে ভারতসন্তান’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি’ গানগুলো তাতে যুক্ত করা হয়।

পরের বছর তথা ১৮৭৫ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লেখেন ‘সরোজিনী’ নাটকটি। যে নাটকের গান তৈরির সময়ে পিয়ানোয় তার তোলা সুরে চৌদ্দ বছরের রবীন্দ্রনাথ কথা জুড়ে তৈরি করেন ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ/ পরাণ সঁপিবে বিধবাবালা’ গানটি।

এই নাটকই যেমন নাট্যকার হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে চেনায়, তেমনই রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার ও গড়ে তোলার পর্বেরও সূচনা করে।

রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জোড়াসাঁকোর তেতলার ছাদের ঘরে তখন থাকতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী। ঘরের লাগোয়া লম্বা ছাদ। সেই ছাদে তৈরি করা হয়েছিল বাগান। ঘরে ছিল একটি গোল টেবিল। দেওয়ালের গায়ে রাখা ছিল পিয়ানো। সেই টেবিল ঘিরে বসতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরী, বালক রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ। এখানেই সরোজিনী নাটক লিখতে লিখতে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করে তাকেও সেই সভায় স্থান দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

বিলেত থেকে ফিরে এই সভায় বসেই রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করতে শুরু করেন তার নিজের সুর। যাতে পাশ্চাত্য সংগীতের ছোঁয়া থাকলেও তা ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত। নতুন ব্রহ্মসংগীত রচনায় তার চেহারা বদলে দেন রবীন্দ্রনাথ।

এরপর তো বিভিন্ন ভাষার বই, বিশেষ করে বহু নাটক তিনি  বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। ইংরেজি থেকে মার্কাস অরেলিয়াস’র মেডিটেশনস ও শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার অনুবাদ করেন।

পিয়েরে লোতি ও থিওফিল গুটিয়ার ছাড়াও ইতিহাস, দর্শন, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস ও ছোটগল্প ফরাসি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছিলেন তিনি। বিশেষ করে, ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত নাটক বাংলায অনুবাদ করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

এর মধ্যে ছিল কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম ও মালতী মাধবা এবং সুদ্রকের বিখ্যাত নাটক মৃচ্চাদিকা।

সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর 

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের মুখপাত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভারতী নামে একটি নতুন ম্যাগাজিনের প্রস্তাব করেন ১৮৭৭ সালে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক থাকলেও মূলত তিনিই পত্রিকাটি চালাতেন।

সংগীতজ্ঞ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংগীতে হাতেখড়ি হয়েছিল শৈশবে। বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন। মূলত  সংগীতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হাতে খড়ি হয়েছিল ১৮৬৭ সালে বড়ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আহমেদাবাদে থাকার সময়। সেসময়  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেতার বাজাতে ও ছবি আঁকতে শেখেন। একই সঙ্গে  ফরাসি ও মারাঠি ভাষাতেও দারুণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। বিশেষ করে পিয়ানো, ভায়োলিন, হারমোনিয়াম ও সিতার বাজানোতে দারুণ দক্ষ ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির ‘সংগীত বিপ্লবে’ মূল ভূমিকা ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। সাহিত্য ও সংগীতে তার সঙ্গী ছিলেন অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী। পরে রবীন্দ্রনাথও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সুরারোপ করতেন ও পিয়ানো বাজাতেন এবং অক্ষয় ও রবীন্দ্রনাথ সুরগুলোতে কথা যোগ করতেন।

রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মায়ের খেলা’য় ব্যবহৃত ২০টি গানেরই সুরকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সংগীতের বিকাশে অসামান্য ভূমিকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। নোটেশনের ধারার পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন তিনি। ১৮৭৯ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিনাবাদিনী নামে একটি সংগীতবিষয়ক ম্যাগাজিন বের করেছিলেন যেটি ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে অন্যতম।

গণিতবিষয়ক একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনার জন্য বেশকিছু গানের সুরারোপ করেছিলেন।

প্রখ্যাত সংগীতবিশারদ ও উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী রাজেশ্বর মিত্র লিখেছেন, ‘এই সময়েও আমরা ঠাকুর বাড়ির সংগীত ও নাট্যসংস্কৃতির উত্থান লক্ষ্য করি, যা সেসময়কার অন্যান্য বাড়ি থেকে পরিমার্জিত ও উজ্জ্বল। এই উন্নতির প্রকল্প করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।’

ব্যবসায়ী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

ব্যবসা-বাণিজ্যেও দারুণ পটু ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ  ঠাকুর। তার পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে নীল চাষ করে অর্থ উপার্জন করতে পেরেছিলেন। যদিও জার্মানিতে রাসায়নিক নীল উদ্ভাবিত হওয়ার পর তিনি নীল চাষের ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারেননি। তিনি তার লাভ অন্য আরেকটি ব্যবসায় নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন।

সেসময়ে খুলনা ও বরিশালের মধ্যে স্টিমার চলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। ১৮৮৪ সালে তিনি স্টিমারের শেল কিনে   ইঞ্জিনের সঙ্গে লাগিয়ে ‘সরোজিনী’ নামে একটি স্টিমার চালু করেছিলেন। তার ব্যবসায়িক সাফল্য দেখে ফ্লোটিলা নামে একটি ইংরেজ কোম্পানিও একই ব্যবসা শুরু করে এবং দ্রুতই তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছড়িয়ে পড়ে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেসময় আরও চারটি স্টিমার কিনেন। সেগুলো তার প্রতিষ্ঠান থেকে স্বদেশী, ভারত, বাংলালক্ষী ও লর্ড রিপন নামে চলতো। কিন্তু, একসময় তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ও যাত্রী ধরে রাখতে ইংরেজ কোম্পানি ভাড়া কমাতে শুরু করে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ভাড়া কমান। দেখা-দেখি ইংরেজ কোম্পানিও ভাড়া কমায়। এক সময় অর্থের প্রকট সংকট দেখা দেয় তার। বিশেষ করে স্টিমারের তেল খরচের টাকাই উঠত না। এক পর্যায়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ ব্যবসায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবু স্বদেশি মনোভাবের কারণে তিনি অন্য ব্যবসা থেকে পুঁজি দিয়েই যাচ্ছেন। কারণ তিনি এক ইংরেজ কোম্পানির কাছে পরাজিত হতে চাননি। কিন্তু, লোকে সে কথা শুনবে কেন! লোকের চাই সস্তা।

১৮৮৯ সালে একদিন হুগলী নদীতে চলার সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি স্টিমার ডুবে যায়। এতে ভয়াবহ সংকট পড়ে যান তিনি। এমন সময় ইংরেজ কোম্পানি ফ্লোটিয়া বাকি তিনটি স্টিমারের কেনার প্রস্তাব দিলে বাধ্য হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে ও স্ত্রী স্বাধীনতা

১৮৬৮ সালের ৫ মে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয়েছিল কাদম্বিনী দেবী নামের এক কিশোরীর সঙ্গে। কাদম্বিনীর বাবা শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ঠাকুর জমিদারির একজন কর্মচারী। মূলত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জেদেই কাদম্বিনীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। ঠাকুরবাড়িতে নববধূর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কাদম্বরী দেবী।

অবশ্য যোগ্য স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠেছিলেন কাদম্বরী। কিন্তু, ঠাকুর পরিবারের স্বামী ছাড়া কেবল ছোট দেবর রবীন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথই মেনে নিতে পেরেছিলেন তাকে। আর কেউই তাকে মেনে নিতে পারেননি।

স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সে যুগে অপরিকল্পিত বিষয় ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজের স্ত্রীকে পড়িয়েছেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে লোকের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার নিজের সংসারে পর্দাপ্রথাকে তিনি আমল নেননি। কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে সবার সামনে দিয়ে বের হতেন।  প্রকাশ্যে সান্ধ্যভ্রমণে যেতেন এবং নিজের শিক্ষা ও শিল্পরুচি দিয়ে স্ত্রীকে সুশিক্ষিতা করে তুলেছিলেন।

কাদম্বরীকে নিয়ে কলকাতার চিৎপুরের রাস্তায় ইডেন গার্ডেনসে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনিই প্রথম নারীর স্বাধীনতা সম্বন্ধে সচেতন করেছিলেন ভারতবর্ষকে।

কিন্তু, তার জীবন যেন হঠাৎই থমকে যায় ১৮৮৪ সালের ২০ এপ্রিল। ঠাকুর পরিবারকে হতবাক করে দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ২৫ বছরের অভিমানী স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

কাদম্বরীর মৃত্যু যেন এক প্রকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন থমকে দিয়েছিল। ঠাকুর বংশের ভরকেন্দ্রটিতে ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছিল। দেখা যায়, ১৮৮৪ সালের পর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যেতে শুরু করে। বিবাহিত রবীন্দ্রনাথ চলে যান শিলাইদহ হয়ে শান্তিনিকেতনে।

দ্বিজেন্দ্রনাথও বাসা বেঁধেছিলেন সেখানে। সত্যেন্দ্রনাথ চলে যান বালিগঞ্জের গুরুসদয় দত্ত রোডের বাড়িতে।

এছাড়াও, হেমেন্দ্রনাথ মারা গেলেন। বীরেন্দ্রনাথের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটল। ১৯০৫ সালে দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর তিন বছর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেল।

১৮৯৮ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত ভারত সংগীত সমাজ’র কাজকর্ম কমে যাওয়ায় তিনি জনজীবন থেকে অবসর নিলেন।

প্রথমে নিজের কোনো সন্তান না থাকায় সত্যেন্দ্রনাথের সন্তানদের সান্নিধ্য তিনি উপভোগ করতেন। শেষ পর্যন্ত ১৯০৮ সালে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে যান, বিহারের রাঁচির মোরাবাড়ি পাহাড়ে শান্তিধাম নামে একটি বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেন। একসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। সেখানেই ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ছেলেকে এককালে তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজের সবাই বলতো দেবেন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রতিভাধর ছেলে। রবীন্দ্রনাথের আগে তৎকালীন সময়ে তিনিই ছিলেন সব্যসাচী। একাধারে নাটক, সংগীত, সম্পাদনা, চিত্রকর্ম— সবকিছু মিলিয়ে তার প্রতিভার ব্যাপ্তি ঘটেছিল। স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর এমন মৃত্যু না হলে হয়তো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দীর্ঘকাল পাওয়া যেত দোর্দণ্ড প্রতাপে। বিশেষ করে, বিংশ শতকের শুরুর দিকে তো তিনি একপ্রকার লোকচক্ষুর অন্তরালেই চলে যান। নয়তো তার সৃষ্টিকর্ম হতো বিপুল ব্যাপ্তিময়।

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

তথ্যসূত্র:

রবি জীবনী/ প্রশান্তকুমার পাল, কবি মানসী/ জগদীশ ভট্টাচার্য ও ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়/ জসীম উদ্দীন

আরও পড়ুন:

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago