সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছগুলো কেন কাটতে হবে?

ইট-সিমেন্টের এই ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুপরিসর সবুজ স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পথ চলতে চলতে এখানকার সবুজ বৃক্ষরাজি বিমোহিত করে বহু মানুষকে। কর্মক্লান্ত বহু মানুষ এখানে হাঁটতে আসেন। আসেন বেড়াতে। এই শহরে এ যেন অক্সিজেন নেওয়ার একটি নির্মল জায়গা। কিন্তু, সেই অক্সিজেনের ভাণ্ডার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেক গাছই কেটে ফেলা হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। পরিবেশবাদীরাও প্রতিবাদ করছেন। তবে, গাছ কাটা থেমে নেই।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান | স্টার ফাইল ছবি

ইট-সিমেন্টের এই ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুপরিসর সবুজ স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পথ চলতে চলতে এখানকার সবুজ বৃক্ষরাজি বিমোহিত করে বহু মানুষকে। কর্মক্লান্ত বহু মানুষ এখানে হাঁটতে আসেন। আসেন বেড়াতে। এই শহরে এ যেন অক্সিজেন নেওয়ার একটি নির্মল জায়গা। কিন্তু, সেই অক্সিজেনের ভাণ্ডার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেক গাছই কেটে ফেলা হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। পরিবেশবাদীরাও প্রতিবাদ করছেন। তবে, গাছ কাটা থেমে নেই।

গত ৩ মে বিবিসি বাংলা এ নিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, উদ্যানের অনেক গাছ কেটে সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু বড় ও পুরনো গাছ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো গগনশিরিষ গাছ, যেগুলোতে চিল বসে। যারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেড়াতে আসেন, তারা জানেন রোজ বিকেলে এখানে আকাশে চিল উড়ে। এ ছাড়াও জারুল, অশোকসহ আরও অনেক গাছ কাটা হয়েছে। আরও অনেক গাছ কাটার প্রস্তুতি চলছে।

কিন্তু, কেন এই গাছগুলো কাটা হচ্ছে? উত্তরে দায়িত্বশীলরা বলছেন, এখানে হাঁটার পথ বা ওয়াকওয়ে করতে হবে। শুধু ওয়াকওয়ের জন্যে নয়, উদ্যানে ঘুরতে আসা সাধারণ মানুষের খাবারের চাহিদা মেটাতে এখানে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁও হবে। সেজন্যও গাছ কাটা পড়ছে।

আচ্ছা ঐতিহাসিক এই উদ্যানেই কেন খাবারের দোকান করতে হবে? এখানে কি কেউ খেতে চেয়েছে? আর গাছগুলো রেখে হাঁটার পথ করা যেত না? কার মাথা থেকে আসে এসব ভাবনা? সবাই যখন গাছ বাঁচায়, কেন আমাদের গাছ কাটতে হবে?

পৃথিবীর গোটা ত্রিশেক শহর দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অধিকাংশ শহরেই রয়েছে দারুণ সব উদ্যান। খুব যত্ন নিয়ে এগুলো রাখা হয়। আমাদের কর্তা-ব্যক্তিরা তো দেশ-বিদেশ ঘুরেন। নিশ্চয়ই তারাও এগুলো দেখেন। তাহলে আমরা কেন এমন উদ্যান বানাই না? যাও বা আছে সেগুলোও রক্ষা করা হয় না কেন?

মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, এই যে আমরা গাছপালা কাটছি, পাহাড়-নদী-খাল সব দখল করছি, এগুলো দেখে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী শিখবে? ১৫ বছর বয়সী সুইডিশ কিশোরি গ্রেটা থুনবার্গ সারাবিশ্বের পরিবেশ নিয়ে ভাবছে। পৃথিবীকে বাঁচাবার জন্যে লড়ছে। এটা কিন্তু একদিনে হয়নি। সে ছোটবেলায় তার চারপাশ থেকে শিখেছে কেন পরিবেশের যত্ন নেওয়া জরুরি। এসব কারণেই তার মাথায় পরিবেশের চিন্তা এসেছে।

আর বাংলাদেশে? আমাদের শিশু-কিশোরদের যতই ভালো কথা আমরা বলি না কেন, ওরা কিন্তু দেখে শিখবে। ওরা যদি ছোটবেলা থেকেই দেখে গাছকাটা, পাহাড়-নদী-খাল দূষণ, দখলই এখানকার সংস্কৃতি, ওরা কী শিখবে?

অবশ্য এবারই প্রথম নয়। গত কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি। অথচ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাসটা কিন্তু বেশ সমৃদ্ধ।

রমনা রেসকোর্স বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস খুঁজতে জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় গিয়ে জানা গেল, মুগল আমলের বাগ-ই-বাদশাহী নামের এই এলাকাটি একসময় রমনা রেসকোর্স হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বৃহত্তর রমনা এলাকাটি একসময় রমনা রেসকোর্স এলাকা থেকে আয়তনে অনেক বড় ছিল।

তবে, মুগল সাম্রাজ্যের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে রমনা ছিল একটি পরিত্যক্ত এলাকা যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানকোঠা, মন্দির, সমাধি ইত্যাদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।

১৮২৫ সালে ঢাকার ব্রিটিশ কালেক্টর ডয়েস ঢাকা নগরীর উন্নয়নকল্পে কয়েকটি বিশেষ উদ্যোগ নেন। ওই সময় কালেক্টর ডয়েস কালী মন্দির ছাড়া অন্যান্য বেশিরভাগ পুরনো স্থাপনা সরিয়ে ফেলেন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে একটি পরিচ্ছন্ন এলাকার রূপ দেন। পুরো এলাকাটি পরিষ্কার করে তিনি এর নাম দেন রমনা গ্রিন এবং এলাকাটিকে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেন।

ঢাকার নবাবদের আনুকূল্যে একসময় ঘোড়দৌড় ঢাকায় খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তারা রেসকোর্স এলাকাটির উন্নয়ন করেন এবং এলাকায় একটি সুন্দর বাগান তৈরি করে তার নাম দেন শাহবাগ বা রাজকীয় বাগান। বৃহত্তর রমনা এলাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে এলাকাটির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর রমনা ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবেই থেকে যায়। শাহবাগ থেকে ইডেন বিল্ডিং (সচিবালয়) পর্যন্ত নতুন একটি রাস্তা করা হয় এবং এই রাস্তার পূর্বদিকের অংশে রমনা পার্ক নামে একটি চমৎকার বাগান গড়ে তোলা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই এলাকা। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্সে তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া এবং এখানেই তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেখানেই এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলিকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে এখানে ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপন করা হয়। একইসঙ্গে উদ্যানের যেখানে পাকিস্তানি সেনারা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল, সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ।

স্বাভাবিক সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই স্বাধীনতা জাদুঘর ও গ্লাস টাওয়ার সংলগ্ন লেকের পাড়ে অসংখ্য মানুষ বেড়াতে আসেন। আশপাশের সবুজ ঘাসে বসে গল্প করেন মানুষ। শিশুরা ছুটে বেড়ায়। এ ছাড়া রোজ সকাল-বিকেল বহু মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন। এমন একটি ঐতিহাসিক স্থানে কি গাছ কেটে উন্নয়ন পরিকল্পনা করা উচিত?

অবশ্য নানা কারণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা নতুন কিছু হয়। নানা সময় এ নিয়ে কম-বেশি প্রতিবাদ হলেও গাছ কাটা থামেনি। এবারও গাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ বিবৃতি দিয়ে গাছ কাটা বন্ধের দাবি জানিয়েছে। আরও অনেকেই প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু, গাছ কাটা বন্ধ হয়নি। বরং নতুন করে আরও অনেক গাছ কাটার জন্যে ‘লাল’ চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। উপর থেকে নির্দেশনা না এলে এই উন্নয়ন যে থামবে না, তা বোঝাই যায়!

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের তৃতীয় প্রকল্পের পরিচালক হাবিবুল ইসলামের কথাতেও সেই আভাস পাওয়া গেল। তিনি দুদিন আগে বিবিসিকে বলেছেন, স্থাপত্য অধিদপ্তরের নকশা অনুযায়ী এখানে সব কাজ হচ্ছে। তার কথা, ‘যেমন গাছ কাটা হচ্ছে, আমার জানা মতে গাছ লাগানোরও একটি বিষয় আছে পাশাপাশি।’

অবশ্য ৫০ বছরের পুরনো একটি গাছ কেটে নতুন একটা গাছ লাগালেই যে প্রকৃতি রাতারাতি স্বাভাবিক হয়ে যায়, তা তো না। এ কারণেই সারাবিশ্বে এখন প্রশ্ন উঠছে— গাছ কেটেই কেন স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে? বিশ্বের বহু দেশে এখন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে গাছ না কেটে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কেন তা করছি না?

সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকার গাছগুলো বাঁচান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত এই স্থানটা যেন নষ্ট না করা হয়। আমাদের গাছ কেটে ওয়াকওয়ে চাই না। এর বদলে গাছের ছায়ায় হাঁটতে চাই। আর এখানে রেস্তোরাঁ চাই না। সবুজ চাই। চাই অক্সিজেন।

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Road crash deaths during Eid rush 21.1% lower than last year

Road Safety: Maladies every step of the way

The entire road transport sector has long been plagued by multifaceted problems, which are worsening every day amid sheer apathy from the authorities responsible for ensuring road safety.

7h ago