মুক্তিযুদ্ধ

৫ মে ১৯৭১: গোপালপুর গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর তথ্য প্রকাশ পাকিস্তানের

শহীদ নগরে গোপালপুর গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৫ মে ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ দিন। এদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আকবর খান। এদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ হাউজ অব কমন্সের অধিবেশনে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে এক বার্তা দেন। এদিন জাতিসংঘের উদ্বাস্তু হাইকমিশনের জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন  (ইউএনএইচসিআর) এর হাইকমিশনার প্রিন্স আগা খান সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারতে যে শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে, তাদের সহযোগিতার জন্য ভারত সরকার জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছে। ভারত স্থায়ী সমাধান চায়। এদিন প্রভাবশালী নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকার দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস।

৫ মে নাটোরের লালপুরে নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে এক নির্মম গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় শহীদ হন ২০০র বেশি  চিনিকল কর্মী। সিলেটের নানিয়ায় পাকিস্তানি হানাদারদের ব্রাশফায়ারে এদিন ২৬ জন শহীদ হন। দেশের নানা জায়গায় হানাদারদের বিরুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রকাশ

৫ মে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অবস্থা ও বিচার নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। এদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দি হওয়ার পর প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য প্রকাশ করলো পাকিস্তান সরকার।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আকবর খান করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত ও সুস্থ আছেন। সামরিক আইন অনুসারে তার বিচারকাজ শিগগির শুরু হবে। সাংবাদিকেরা এসময় বঙ্গবন্ধুকে একবার দেখার অনুমতি চাইলে অনুমতি দেয়া হয়নি।

মার্কিন চার সিনেটরের পররাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি ডেভিড অ্যাবশায়ারকে লেখা একটি চিঠি ৫ মে প্রকাশ করা হয়। এই চিঠিতে সিনেটরেরা অভিযোগ করেন চীনের আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান সরকারকে সামরিক সাহায্যের তহবিল থেকে যেসব যুদ্ধ বিমান ও ট্যাংক দেয়া হয়েছিল এখন তারা সেগুলো পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ওপর ব্যবহার করে গণহত্যা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তান সরকারের কাছে এর জবাব চাওয়া।

বিদেশি রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের বিবৃতি

৫ মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ হাউজ অব কমন্সের অধিবেশনে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে এক বার্তা দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ অবস্থা চলছে। ভারতে প্রতিনিয়ত শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। একটি হিসেব আমরা পেয়েছি, যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে। এখন ভারতের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘসহ অন্যান্য দেশগুলোর উচিত পর্যবেক্ষক দল পাঠানো।’

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) এর হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য ভারত সরকার জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের কারণে ভারতে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে, এতে চরম মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের শরণার্থী শিবিরেও শরণার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ভারত এর স্থায়ী সমাধান চায়। জাতিসংঘ চাইলে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমরা চাই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক যেন আর কোনো সাধারণ মানুষকে শরণার্থী হয়ে ভারতে আসতে না হয় এবং যারা শরণার্থী হয়ে এসেছে তারা যেন নির্দ্বিধায় স্বদেশে ফিরে যেতে পারে।’

৫ মে মালয়েশিয়ার প্যান মালয়েশিয়া ইসলামিক পার্টি জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে এক স্মারকলিপি দেয়। জাতিসংঘ সেক্রেটারি উ থান্টের কাছে দেওয়া সেই স্মারকলিপিতে অভিযোগ ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চরম হস্তক্ষেপ করছে ভারত। ভারতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে দেশদ্রোহীরা। জাতিসংঘের এই মুহূর্তে এই বিষয়ে  পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

নিউ ইয়র্ক টাইমসে রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলসের সাক্ষাৎকার

৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রকে দেয়া অস্ত্র কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে এবং কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা জানা জরুরি। আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দুটো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। একটি পাকিস্তান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেওয়া অস্ত্র অপব্যবহারের জন্য কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে দক্ষিণ এশিয়া ও গোটা এশিয়ায় শান্তি ক্ষুন্ন হবার বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ এখন এটি খুবই স্পষ্ট যে এশিয়ার শান্তি ক্ষুন্ন হবার প্রবল আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক চরম অবনতি হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানের লড়াই এখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। কারণ পাকিস্তানের  সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্বারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে নিপীড়নের মাধ্যমে দমিয়ে রাখা হয়েছে। পাকিস্তান সরকার এবং তাদের সামরিক বাহিনী ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে সব কিছু চাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। এখন এই সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের বিশেষ দায়িত্ব আছে, জাতিসংঘের উচিত এই ব্যাপারে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া।

ঢাকায় শান্তিবাহিনীর বৈঠক

৫ মে ঢাকার ধামরাই থানায় শান্তিবাহিনীর এক বৈঠকে মোজাম্মেল হককে সভাপতি এবং শমসের আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে ধামরাইয়ে ১০৮ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি।

গোপালপুর গণহত্যা

৫ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নাটোরের লালপুরে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে, মিলের জেনারেল ম্যানেজার লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিমসহ ২০০ এর বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মিল চত্বরের পুকুর পাড়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। সেদিন বন্দিদের মধ্যে কেবল পাঁচ জন কর্মচারী প্রাণে বাঁচেন। তারা হলেন আবদুল জলিল শিকদার, খোরশেদ আলম, আবুল হোসেন, ইমাদ উদ্দিন এবং ইঞ্জিল সর্দার।

৫ মে, পাকিস্তানি হানাদারেরা নাটোরের লালপুলের গোপালপুরে পৌঁছায়। এসময় বাঙালিদের শক্ত ঘাঁটি চিনিকল দখল করে ফেলে। প্রায় ২০০ বাঙালি জনগণ যারা মূলত চিনিকলের কর্মচারী ছিল, সবাইকে জড়ো করে প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম আত্মসমর্পণ করেন  অনুরোধ করেন যেন নিরীহ লোকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেনারা লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম ও তার পরিবারকে গুলি করে হত্যা করে। বন্দি কর্মচারীদের চিনিকলের ভিতরে একটি পুকুরের সামনে লাইনে দাঁড় করানো হয় এবং গুলি করে মারা হয়। মৃতদেহগুলোকে পুকুরে নিক্ষেপ করা হয়।

ঢাকার বাইরে প্রতিরোধ যুদ্ধ ও গণহত্যা

৫ মে নবম সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল বরিশাল ফের মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এমপিএ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও লেফটেন্যান্ট নাসেরকে সঙ্গে নিয়ে দুটি লঞ্চে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ নিয়ে ভারতের শমসেরনগর থেকে বাংলাদেশের দিকে আসতে থাকেন। এদিন কপোতাক্ষ নদের তীরে গাবুরা চরের কাছে লঞ্চ দুটি পৌঁছালে পাকিস্তানি হানাদারেরা গানবোট দিয়ে তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এই সময় আকস্মিক আক্রমণে এমপিএ মহিউদ্দিন ও অ্যাডভোকেট সর্দার জালালসহ ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে বন্দি হন এবং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ লঞ্চ দুটিও ধ্বংস করে পাকিস্তানি হানাদারেরা।

৫ মে চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির রামগড় সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি হানাদারদের তীব্র সংঘর্ষ হয়।

৫ মে পিরোজপুরের এসডিও আবদুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান ও এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদকে পাকিস্তানী হানাদারেরা দালালদের সহযোগিতায় গ্রেফতার করে। তারা সবাই ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সমর্থক। পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের বাবা।

সিলেটের নানিয়ায় ৫ মে পাকিস্তানি হানাদারেরা পৈশাচিক নির্যাতনের পর গুলি করে ব্রাশফায়ার করে ২৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

৫ মে ১নং সেক্টরের আওতায় প্রথম ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এই দল গঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা। পরবর্তীতে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল।

তথ্যসূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ষষ্ঠ, অষ্টম, নবম ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান ৬ মে ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৬ মে ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

আরও পড়ুন-

৩ মে ১৯৭১: টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন- ঢাকা এখন মৃত্যুপুরী

১ মে ১৯৭১: ‘বাংলাদেশ এখন একটি চিরন্তন সত্য ও বাস্তবতা’ ভারতীয় শিল্পমন্ত্রী

২৭ এপ্রিল ১৯৭১: কালীগঞ্জে গণহত্যা, ইপিআরের নাম পাল্টে ইপিসিএফ

সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে যিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজের প্রাণ

১৯ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা

১৮ এপ্রিল ১৯৭১: বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন

স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সূচনা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

5m ago