কফি চাষের সম্ভাবনা বাড়ছে বাংলাদেশে
পঞ্চাশের দশক থেকেই ব্যক্তি পর্যায়ে ভারতের মিজোরাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষকরা কফি বীজ ও এর চারা এনে পাহাড়ে চাষ শুরু করেন। সে সময় থেকে পাহাড়ের কৃষকরা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মিউসিলেসযুক্ত (পিচ্ছিল মিষ্টি আবরণ) ভেজা পার্চমেন্ট থেকে কফি বিন সংগ্রহ করে চুলায় ভেজে নিজেদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতেন। মিউসিলেসযুক্ত ভেজা পার্চমেন্ট হলো কফি ফল গাছ থেকে পাড়ার পর পেষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পিষে উপরের চামড়া আলাদা করার পর পাওয়া বিশেষ অবস্থা। কফিতে ক্যাফেইন বিদ্যমান থাকায় তারা এটিকে নেশা হিসেবেও ব্যবহার করতেন। একইভাবে সেচসহ উপকরণ ব্যয় খুবই কম লাগায় এবং অপেক্ষাকৃত কম রোগবালাই হওয়ায় পাহাড়ি কৃষকরা কফির চাষাবাদে শুরু থেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমানে তিন জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং টাংগাইল, রংপুর ও নীলফামারীতে খুব স্বল্প পরিসরে কফি উৎপাদিত হচ্ছে।
কফি গাছ ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচার ইতিহাস আছে। কফি গাছ লাগানোর ৩ বছর পর ফল দেয়। যদিও বেশি পরিমাণ ফল পেতে ৬-৭ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। একটি অর্থকরী ফসল হওয়ায় কফি চাষ করে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হবে তেমনি এটি বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ বলে জনগণের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করবে।
কফি গাছে সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল আসে এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রতি সোয়া ৬ কেজি তাজা কফি ফল থেকে ১ কেজি শাঁসযুক্ত কফি বিন পাওয়া যায়। প্রতি ১ কেজি শাঁসযুক্ত কফি বিন থেকে ৭৫০ গ্রাম ফ্রেশ কফি বিন বা বীজ পাওয়া যায়। বিভিন্ন খরচ বাদ দিলে কফি চাষ করে পাহাড়ি কৃষকরা একর প্রতি বছরে প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা নিট মুনাফা করে থাকেন বলে তাদের কাছ থেকে জানা গেছে।
বাংলাদেশে কফি বিন হিসাবে বাজারজাত করার বেশ সুযোগ আছে। কাঁচা অবস্থায় কৃষকরা বিক্রি করে লাভবান হতে পারলেও রোস্টিং ও প্যাকেটিং না করা হলে লাভের পরিমান অনেক কমে যাবে। বর্তমানে কৃষকরা যতটুকু চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করছে তার সবটুকুই সনাতন পদ্ধতিতে করছে যার ফলন অনেক কম এবং লাভও কম হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে চাহিদার বেশিরভাগ অংশই (প্রায় ৯৫ শতাংশ) পূরণ হচ্ছে আমদানিকৃত কফি দিয়ে। উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং, ডিএই সূত্র মতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমদানি করা গ্রিন কফির পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৫১৭ মেট্রিক টন। তাই আমাদের কফির উৎপাদন বৃদ্ধিতে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কফি চাষের অনুকূল, তবে ভালো ও উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে এর চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাহাড়ি এলাকায় বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কফি চাষের উপযোগী মাটি হলো গভীর, ঝুরঝুরে, জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ও হিউমাস সমৃদ্ধ, হালকা অম্ল মাটি (পিএইচ ৪.৫-৬.৫)। কফি হালকা ছায়ায় ভালো হয় এবং অতিরিক্ত সার ও সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না, যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। রৌদ্রোজ্জ্বল স্থানে চাষ করলে সার ও সেচের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া এর সাথে আন্তঃফসল হিসেবে পেঁপে, আনারস, গোলমরিচ অনায়াসে চাষ করা যায়।
পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদযোগ্য কফির ২টি জাত রয়েছে। যেমন- কফি এরাবিকা (Coffea arabica) এ কফি রোবাস্টা (Coffea canephora – robusta)। এরাবিকা জাত আমাদের দেশে চাষ উপযোগী তবে ফলন কম হয়। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খুব উপযোগী এবং এই জাতের কফি গাছে রাস্ট রোগ কম হয়। এটি সাধারণত সমুদ্র থেকে ৫০০-১০০০ মিটার উচ্চতায় এবং ১০০০-২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ভালো ফলে সেজন্য বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা যেমন -পার্বত্য অঞ্চল ও টাংগাইলের মধুপুর গড়ের আবহাওয়ায় এটির সম্প্রসারণ সম্ভব। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ১২ শতাংশ জমির এলিভেশন প্রায় ১০০০ মিটার। পাহাড়ি এলাকা বাদেও বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় কফির চাষ করা যাবে। নীলফামারী ও রংপুর এলাকার মাটি ও আবহাওয়া কফি চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী ।
চারা রোপণ, ফল সংগ্রহ থেকে শুরু করে কাপে পানযোগ্য কফি পেতে অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়।
১. কফির বেরি যখন পেকে গাঢ় লাল বা হলুদ রং হয় তখন এগুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। বছরে এক বার ফলন সংগ্রহ করতে হয়। বিশ্বের কোথাও কোথাও হাত দিয়ে আবার কোথাও যেমন সমতল ভূমিতে যন্ত্রের মাধ্যমে ফল সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহকৃত পাকা কফি পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
২. প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পৌঁছানোর সাথে সাথেই এর কার্যক্রম শুরু করে দিতে হয়, না হলে পচন ধরতে পারে। শুকনো ও ভেজা দুই ভাবে এটি করা যায়। শুকনো পদ্ধতিতে কফি বীজগুলো রেকে বা মাটিতে অন্য কিছু বিছিয়ে তাতে পাতলা করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সূর্যের আলোতে এটি শুকানো হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত কফি বীজের আর্দ্রতা ১১ শতাংশ হয়। তবে এটি অনেক সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি। অন্যদিকে ভেজা পদ্ধতিতে পাল্পিং মেশিনের মাধ্যমে উপরের নরম ও পাল্প আবরণ সরানো হয়। এরপর পানির চ্যানেলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রোটেটিং মেশিনের মাধ্যমে বীজের আকার অনুসারে গ্রেডিং করা হয়। ফার্মেন্টেশনের জন্য এই বীজগুলোকে রাখা হয় পানি ভর্তি বিশাল ট্যাংকে ১২-২৪ ঘণ্টা। তারপর বীজের ওপরের পাতলা পর্দা সরে যায় ও পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে শুকানো হয়।
৩. ভেজা পদ্ধতিতে সংগৃহীত কফি বীজগুলোকে রোদে বা ড্রায়ারে আর্দ্রতা ১১ শতাংশে না পৌঁছানো পর্যন্ত শুকাতে হবে, এই অবস্থার কফিকে পার্চমেন্ট কফি বলে। তারপর ব্যাগে ভরে সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. হালিং মেশিনের মাধ্যমে পার্চমেন্ট লেয়ার সরাতে হবে বা সম্পূর্ণ শুকনা আবরণ সরাতে হবে। যদিও পলিশিং করলে এর গুণগত মান বাড়ে তবুও এটি করা বাধ্যতামূলক বা জরুরি নয়। আকার ও ওজন দেখে কফিকে গ্রেডিং ও বাছাই করতে হবে। নিশ্চিতভাবে ভালো গ্রিন কফিগুলো রাখতে হবে রপ্তানির জন্য।
৫. বাছাইকৃত গ্রিন কফিকে রোস্টিং করে তৈরি করা হয় সুঘ্রাণযুক্ত বাদামি কফি বীজ যেটা আমরা সুপার সপ বা ক্যাফে থেকে কিনে থাকি। বেশিরভাগ রোস্টিং মেশিনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রায় ৫৫০ ডিগ্রা ফারেনহাইট। এই সময়ে সঠিকভাবে তাপমাত্র নিয়ন্ত্রণ করা জরুই কারণ এই ধাপেই সৃষ্টি হয় অসাধারণ স্বাদ ও ঘ্রাণ। এই প্রক্রিয়াকে বলে পাইরোলাইসিস। রোস্টিং এর পর অতি দ্রুত ঠান্ডা করতে হবে। তাহলেই এর স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকবে যার জন্য ক্রেতা অনেক বেশি আকৃষ্ট হবে কেনার জন্য।
৬. কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ গ্রাহকের কাপ পর্যন্ত রাখতে হলে সঠিকভাবে কফি গ্রাইন্ডিং করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কফি বীজ গুড়া করা যত মিহি হবে তত দ্রুত সুন্দর কফি তৈরি হবে।
৭. আধুনিক বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে ব্ল্যাক কফি বা মিল্ক কফি তৈরি করে কফি প্রেমিদের সন্তুষ্টি করা যায়। পাটের ব্যাগ বা অন্যান্য বায়ুরোধী ব্যাগে ভরে রপ্তানি করতে হয়।
কফির স্থানীয় চাহিদা অনেক বেশি এবং রপ্তানির সুযোগও আছে, তাই বাড়তি উৎপাদিত কফি হতে পারে বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বিকল্প আয়ের উৎস। এর জন্য প্রয়োজন শুধু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। কৃষি উদ্যোক্তা, গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মী, বেসরকারি সংস্থা ও বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা এবং মিডিয়াকে কফি চাষে এগিয়ে আসতে হবে। এর মধ্যেই কিন্তু সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। ধীরে ধীরে এগুচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগও।
বাংলাদেশে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কফির উৎপাদন, সম্প্রসারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বেশকিছু গুরুত্বপূণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একই সাথে অতি সম্প্রতি রাজস্ব বাজেটভূক্ত প্রায় দুইশ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলছে। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী কফির বর্তমান অবস্থা নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ, চাষীদের প্রযুক্তিগত পরামর্শ এবং নতুন বাগান সৃজনে উদ্বুদ্ধকরণ, গুণগতমান সম্পন্ন কফির চারা/ কলম সরবরাহ, চাষ বৃদ্ধির জন্য হাইব্রিড কফির কলম সংগ্রহ ও বিতরণ, ভিয়েতনাম থেকে Coffea robusta জাতের কফির কলম আনা, প্রাথমিকভাবে ‘হোমস্টেড কটেজ ইন্ড্রাস্ট্রি’ স্থাপনের জন্য ১০টি কৃষক গ্রুপকে প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের যন্ত্রপাতি দেওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টারের অনেকগুলোতেই এখন কফির বাণিজ্যিক চারা-কলম উৎপাদন ও সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রয় হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে কফির চাষ বাড়াতে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান অবদান রাখছে তার মধ্যে অন্যতম নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) মোনঘর, রাঙ্গামাটি, অরণ্যক ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণও কফির চারা বিতরণ করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকায় এদেশে কফি চাষ বাড়ানো সম্ভব। আধুনিক প্রক্রিয়াজাত মেশিন ও প্রযুক্তি সহজলভ্যতা হলে এর চাষ বৃদ্ধি পাবে। তাহলেই কফির স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বৃদ্ধি করা যাবে। খরপোষের কৃষি থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের কৃষি হবে বাণিজ্যিক কৃষি। এভাবেই কৃষি ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ।
লেখক: অতিরিক্ত উপপরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর [email protected]
আরও পড়ুন-
Comments