সর্বভারতের প্রেরণা প্রীতিলতা
বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার দার্শনিক সফোক্লিসের সৃষ্ট অমর চরিত্র- এন্টিগন। তার পিতা রাজা ইডিপাস। ফলে রাজকন্যা হিসেবে পরিচিত এন্টিগন গতানুগতিক চিন্তার বাইরে ছিলেন। নাট্যকার সফোক্লিস নিজে বিদ্রোহী না হলেও তার চরিত্র ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। পথের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন একাকী। পরিণত জেনেও পিছপা হননি রাজকন্যা। কেবল বিবেকের তাড়নায় সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
রাজাহীন আমাদেরও ছিল রাণী। সাধারণ মায়ের অসাধারণ রাণীকে সবাই জানেন প্রীতিলতা হিসেবে। স্বাধীনতা সংগ্রাম, রাষ্ট্র রাজনীতি সচেতন মানুষমাত্র অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে অনুভব করেন, ধারণ করেন মন মননে।
১৯১১ সালে ৫ মে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রীতিলতা৷ তার বাবা স্থানীয় পৌর দপ্তরের কেরানি জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মা প্রতিভাদেবী৷ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় প্রীতিলতা এবং তার সহপাঠী বীণা দাসগুপ্ত কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয় তাদের৷ ৮০ বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে (২০১২ সালের ২২ মার্চ) তাদের দুজনকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি দেওয়া হয়।
স্নাতক পরীক্ষার পর চট্টগ্রাম ফিরে এসে মাস্টার দা সূর্যসেনের সাথে দেখা করতে আগ্রহী হন। সহজে মাস্টারকে পাওয়া যায় না, গোপনে থাকেন। তবে কলকাতা থাকাকালে বোন পরিচয়ে রামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রীতিলতার দেখা করার বিষয়টি চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতারা অনেকে জানতেন। সেসব গল্প শোনার জন্য সূর্যসেনও উৎসুক ছিলেন বলে জীবনীকারদের ভাষ্যমত। তাই মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করার বিষয়টি সহজ হয়। এর মধ্যে একই উদ্দেশ্যে সমমনা কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলিপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে আসেন। ওই সময় অর্পণাচরণ দের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রীতিলতা নিযুক্ত হন শিক্ষক হিসেবে।
এখান থেকে গোপনে সাবিত্রী দেবীর বাসায় প্রীতিলতার সঙ্গে মাস্টার দা সূর্যসেনের দেখা করার ব্যবস্থা করেন। মাস্টার দাকে জানান, মৃত্যুর জন্য অসম্ভব প্রশান্তির সঙ্গেই অপেক্ষা করছেন রামকৃষ্ণ। আর রামকৃষ্ণের ফাঁসির পরই কলকাতা ছেড়ে চট্টগ্রামে আসেন। সেই দ্রোহে মনের মধ্য থেকে সমাজ-সংসার সবই হারিয়েছেন প্রীতিলতা। একই সাথে মাস্টার দাকেও প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মেয়েদের আপনারা দলে নিতে চাইতেন না কেন দাদা? তারা কি দেশসেবার যোগ্য নন?’ মাস্টার দা জবাব দিয়েছিলেন, ‘’না, দেশসেবার কঠিন কর্তব্য থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা চলে না। দেশসেবায় নরনারী ভেদ নেই।’’ মাস্টার দার পাশে তখন রাখা আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী ড্যানিয়েল ব্রিন-এর সেই বিখ্যাত বই, ‘মাই ফাইট ফর আইরিশ ফ্রিডম’। বইটা পড়ার জন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রীতিলতা। মাস্টার দার নির্দেশেই গৃহত্যাগ করেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় সেই খবর, ‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতি ওয়াদ্দেদার গত ৫ জুলাই, মঙ্গলবার, চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানে ব্যস্ত।’
সেই সাক্ষাতে নেতাদের মধ্যে সঙ্গে এসেছিলেন সূর্যসেন ও নির্মল সেন। আর দেখা করার পর থেকে তার মন হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপাগল। অথচ অঞ্চলে বিপ্লবী দলের কার্যক্রম ২৫ বছর পার হলেও তার মধ্যে কোনো মেয়ে বিপ্লবী সাক্ষাত সংগ্রামে যোগ দিলো না। কারণ সময়- স্থান ছিলে ভয়াবহ। জানা যায় ধলঘাটে ব্রিটিশ পুলিশ-মিলিটারির একটি ক্যাম্প ছিল। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের পর ক্যাম্পটি বসানো হয়। তাতে অত্যাচারের কথা সবাই জানতেন। তবে তারা শত অত্যাচার করেও কোনো খবর বের করতে পারেনি বিপ্লবীদের কাছ থেকে।
প্রীতিলতার সহপাঠী কল্পনা দত্ত স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘কোনো কোনো সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রাণী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদের আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসেবে দেখা শুরু করলাম।’
খ.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস দুইবোন। প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে কলকাতা থেকে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি শর্মিলা, উর্মিমালা চরিত্ররা দুইজন দুই রকম হলেও প্রিয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে বলেন, সোনার বীণায় একটি নিভৃত নীরবের ঝঙ্কারের অপেক্ষায়, যে ঝঙ্কারে বেজে ওঠে সর্ব দেহ মনে অনির্বচনীয় বাণী। প্রীতিলতা আমার এমনি মনে হয়। যুক্ত হয় আত্মার বোন বান্ধবী কল্পনা দত্ত। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম।
এর মধ্যে ঘটে যায় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরেই ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানেও প্রতিশোধ হিসেবে দামপাড়া ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হয়। ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম কার্যসূচিতে সেদিন গুড ফ্রাইডে হওয়ায় ক্লাব বন্ধ থাকায় তারা ব্যর্থ হন। দ্বিতীয়বার বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে এলে আবার ব্যর্থ হন। ব্যর্থতার দায়ে শৈলেশ্বর চক্রবর্তী কাট্টলীর সমুদ্র উপকূলে নিজের বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।
এবার সূর্যসেন পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণের জন্য নতুনভাবে ভাবতে থাকেন। সাথে সাথে নারী বিপ্লবীরা যে অনেকদিন ধরে প্রত্যক্ষ কাজে যুক্ত হবার আগ্রহ জানিয়েছে তা তার মনে পড়ে। সে খেয়ালেই একজন নারীকেই ক্লাব আক্রমণের নেতা করবেন বলে ঠিক করেন। সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে নিখুঁত পরিকল্পনা করেন। প্রত্যক্ষভাবে নির্দেশ ও তদারকি করার জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর কাট্টলী চলে আসেন মাস্টার দা এবং নিয়ে আসেন প্রীতিলতাকেও। তাকে জানিয়ে দেন পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে এবং এর নেতৃত্বভার তাকেই গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে যখন তিনি দেখেন প্রধান নেতা তার চোখে গভীর বিশ্বাসে দৃষ্টা ফেলছে। তখনি তাকে প্রণাম করে সিদ্ধান্ত নেন সফল হওয়ার।
মারা যাওয়ার আগের দিন। ১৯৩২ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তার মাকে চিঠি লিখেন। মৃত্যুর পর মাস্টার দা চিঠিটি তা মায়ের হাতে পৌঁছে দেন। সেখানে লেখা ছিল, “মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো- তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম। তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দুঃখ দেয়া আমার ইচ্ছা নয়। আমি স্বদেশ-জননীর চোখের জল মোছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ কর, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না।”
হামলার দিন ছিল শনিবার, নিজ হাতে সূর্যসেন প্রীতিলতাকে সামরিক পোশাক পরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় ৪০ জন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন রাত ১০টা নাগাদ। প্রীতিলতার পরনে ছিল খাকি শার্ট, ধুতি, মাথায় পাগড়ি ও কোমরে চামড়ার কটিবদ্ধে রিভলভার। অভিযানের শেষ দিকে হঠাৎ একজন গুর্খা অফিসারের ছোড়া গুলিতে প্রীতিলতা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী ধরা না দিতে মুখে পুরে দেন পটাশিয়াম সায়ানাইড। তারপর মারা যান। সফোক্লিসের অমর সৃষ্টি- এন্টিগনও অনাহারে মরার আগে আত্মহত্যা করেন।
আক্রমণের পর কলকাতায় ইংরেজদের প্রধান দৈনিক “ইংলিশম্যানে” বলা হয় এই অভিযানে ৫৩ জন ইংরেজ নরনারী হতাহত হয়। (পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামের একজন ইংরেজ নারী নিহত হন এবং চার জন পুরুষ ও সাত জন নারী আহত ) পত্রিকার সংবাদদাতা প্রীতিলতার সাহসকে প্রশংসা করে ‘অসম সাহসীকা’, ‘বীর নারী’ ইত্যাদি বিশেষণ প্রয়োগ করেছিলেন। এইসব দেখে কলকাতার ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন প্রবল প্রতিবাদ করায়, ওই সাপ্তাহিকের পরবর্তী সংখ্যায় দুঃখ প্রকাশ করে ওই বিশেষণগুলো প্রত্যাহার করে নেয়।
পূর্ণেন্দু দস্তিদার রচিত প্রীতিলতার জীবনীতে তিনি লিখেন ‘চট্টগ্রামের একটি তরুণী নিজের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত করার জন্য যে “মরণ-স্বপন” দেখেছিল, তার কর্মপন্থা যুগের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু তার দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত, তার অটুট আদর্শ নিষ্ঠা আজও কেবল স্বাধীনতাকামী মানুষজন নয়, সব শ্রেণির নারীর কাছে প্রীতিলতা আজ এক উজ্জ্বল প্রেরণা।’
তথ্য সহায়ক:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ দুই বোন
মালেকা বেগম/ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
পূর্ণেন্দু দস্তিদার/ প্রীতিলতার জীবনী
আহমেদ মুনির/ মুক্তির পতাকাবাহী
চিন্ময় চৌধুরী/ প্রথম বিপ্লবী নারী ও শহীদ প্রীতিলতা
সাগর লোহানী/ প্রীতিলতা: আত্মবিসর্জনে মহিমান্বিত
Comments