কোভিড সংকটে স্বস্তির বাতাস
করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের হাসপাতালে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে। এ অবস্থায় বুয়েটের কয়েকজন গবেষক স্বল্পমূল্যের ও সহজে বহনযোগ্য একটি ভেন্টিলেটর তৈরি করেছেন। যেটি বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়াই রোগীদের কার্যকরভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে।
সহজেই বহনযোগ্য এই যন্ত্রটিকে একটি সিলিন্ডার বা মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহের উৎসের সঙ্গে যুক্ত করে ব্যবহার করা যায়।
গবেষকদের মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যেসব রোগীদের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কম, তাদের ব্যবহার উপযোগী করে যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছে।
বুয়েটের বায়োমেডিকেল প্রকৌশল বিভাগের গবেষকরা এ যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘অক্সিজেট সিপিএপি’। ইতোমধ্যেই যন্ত্রটির ফিল্ড টেস্টের কাজ শেষ হয়েছে এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্যেও অনুমোদন পেয়েছে।
দূরবর্তী গ্রামগুলোতে অথবা অ্যাম্বুলেন্সে—যেখানে সিলিন্ডার বহন করা সম্ভব, সেসব স্থানে যন্ত্রটি ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া যন্ত্রটিকে হাইফ্লো ন্যাজাল অক্সিজেন (এইচএফএনও) সহায়তার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রকল্পটির ব্যবস্থাপক এবং সহউদ্ভাবক ডা. তৌফিক হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা বাহ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য সিপিএপি ভেন্টিলেটর তৈরি করেছি, যা বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াই চলতে পারে। যন্ত্রটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সাধারণ ওয়ার্ডের রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা। যাতে তাদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার প্রয়োজন না হয়।’
চলমান কোভিড-১৯ সংকটে দেশে অক্সিজেনের উচ্চ চাহিদার কথা মাথায় রেখে তারা এ উদ্যোগটি নিয়েছেন।
তিনি জানান, উচ্চ ঘনত্বের অক্সিজেনের জন্য হাসপাতালের ‘চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত অক্সিজেন’ ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো। তবে, জরুরি পরিস্থিতিতে অক্সিজেট পিপিএপি ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও এটি খুব বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা যায় না।
দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে রোগীদের মিনিটে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার করে অক্সিজেন দেওয়ার মতো অবকাঠামো আছে।
যখন একজন গুরুতর অসুস্থ রোগীর আরও বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, তখন তাদের সাধারণত এইচএফএনও চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিরামহীন বায়ুচাপ পদ্ধতি বা সিপিএপি ব্যবহার করা যায়।
রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী, আইসিইউতে ভর্তি করানোর আগে সাধারণ ওয়ার্ডে অক্সিজেট সিপিএপির মাধ্যমে মিনিটে সর্বোচ্চ ৬০ লিটার করে শতভাগ বিশুদ্ধ অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব।
বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী, সিপিএপি বা এইচএফএনও’র মতো শ্বাসপ্রশ্বাসে সহায়তা দেওয়ার এ ধরনের বাহ্যিক কৌশলগুলো চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে খুবই লোভনীয়। যার মাধ্যমে আমরা যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ঝুঁকিগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারি।
এইচএফএনও-এর মাধ্যমে রোগীর শরীরে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য বাতাস বা অক্সিজেন ব্লেন্ডার, একটি কার্যকর হিউমিডিফায়ার, একটি সিঙ্গেল হিটেড সার্কিট ও একটি ন্যাজাল ক্যানুলার দরকার পড়ে। এটি গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য উপযোগী ব্যবস্থা হলেও সরকারি হাসপাতালের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
অন্যদিকে, অক্সিজেট সিপিএপির জন্য দরকার একটি সাধারণ সিপিএপি মাস্কের সঙ্গে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও অক্সিজেনের উৎসের সঙ্গে সংযোগ। এর জন্য কোনো বিদ্যুৎ সংযোগেরও দরকার হয় না।
ডা. তৌফিক বলেন, ‘আমরা আশা করি, আমাদের যন্ত্রটি এইচএফএনও’র একটি সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এর মাধ্যমে যেসব রোগীদের কোভিড-১৯ ওয়ার্ডে করোনা সন্দেহে কিংবা নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে, তাদের আইসিইউতে ভর্তি করানোর প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন কোভিড-১৯-এর সর্বোচ্চ সংক্রমণের মুখোমুখি। এ অবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণ হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা যন্ত্র জোগাড় করা সম্ভব নয়। এছাড়া, প্রয়োজন অনুযায়ী অভিজ্ঞ সঞ্চালকের অভাবে এ যন্ত্রগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করাও সম্ভব না।’
বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে ইতোমধ্যেই অক্সিজেট সিপিএপি প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পাস করেছে। এছাড়া দৈবচয়নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে অংশ নেওয়ার জন্য অনুমতি পেয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে যন্ত্রটির নিরাপত্তাব্যবস্থা ও উপযোগিতাকে এইচএফএনও’র সঙ্গে তুলনা করা হবে।
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালটি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ডা. তৌফিক বলেন, ‘যদি ট্রায়ালটি সফল হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এবং চিকিৎসকদের উপদেশ পাওয়া সাপেক্ষে যন্ত্রটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার স্বল্পমূল্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।’
অক্সিজেট সিপিএপি প্রকল্পটির অর্থায়নে রয়েছে অংকুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন, সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাসান চৌধুরী বলেন, ‘তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে ২০ জন রোগীকে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হবে। একইসঙ্গে আরও ২০ জন রোগীকে অক্সিজেট সিপিএপি’র মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ১৪ জন রোগীকে ট্রায়ালের সঙ্গে সংযুক্ত করেছি এবং তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। দুমাসের মধ্যে আমরা পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশের ব্যাপারে আশাবাদী।’
গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ডা. ফরহাদ জানান, যেসকল রোগীর প্রতি মিনিটে ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন দরকার হয়, তাদের ক্ষেত্রে অক্সিজেট সিপিএপি ব্যবহার করা হচ্ছে। মাত্র এক ঘণ্টার প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরই যেকোনো চিকিৎসক যন্ত্রটিকে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এইচএফএনও যন্ত্র ব্যবহারের প্রক্রিয়াটি আরও বেশি জটিল।
ভেন্টিলেটরটির আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এর দাম অনেক কম। প্রতিটি যন্ত্র তৈরিতে খরচ হয় মাত্র ২৫ হাজার টাকার মতো। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হলে খরচ আরও কমে আসবে বলেও জানান ডা. তৌফিক।
(প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান)
Comments