‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ’
ভাঙা-গড়ার খেলায় কমলাপুর রেলস্টেশন, টিএসসির মতো আইকনিক ভবনগুলোর নাম যোগ হওয়ার পর এবার আলোচনায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। খাবার হোটেল ও হাঁটার রাস্তা তৈরির জন্য কাটা হচ্ছে উদ্যানের গাছ।
ঐতিহাসিক এই উদ্যানেই কেন খাবার হোটেল করতে হবে? গাছ রেখেই কি হাঁটার রাস্তা তৈরি করা যেত? সবাই যখন গাছ বাঁচায়, আমাদের কেন গাছ কাটতে হবে? গাছ কাটার কেমন প্রভাব পড়বে? দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নগর বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ও ঢাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের সঙ্গে।
শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গাছ কাটার বিষয়ে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ। আমাদের এই শহরে এমনিতেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাছ নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই গাছ কাটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। এটা সবদিক থেকে কেবলমাত্র ক্ষতিরই কারণ হবে। গাছ কাটার কারণে শুধু এখানেই ক্ষতি হবে তাই না, এখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নয়নের নামে অন্য জায়গা থেকেও গাছ কাটা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহরের একটা বড় জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এখানে সবই থাকবে, মানুষ যাবে। কিন্তু কোনো কারণেই গাছ কাটা যাবে না। যত উন্নয়নই হোক, গাছ রেখেই করতে হবে। গাছ কেটে এই উন্নয়ন হওয়ার অর্থ এটা একটা নিদর্শন হয়ে থাকা। অবিলম্বে এই গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। যেসব জায়গা থেকে গাছ এরই মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে সেখানে দ্রুত আরও গাছ লাগাতে হবে। যে উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, সেটা সংশোধন করতে হবে। গাছ কাটায় অনেকে আন্দোলন করছে, সেটা তো হবেই।’
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্লাস টাওয়ার তৈরি কমিটির সদস্যদের মধ্যে আমি একজন। সেখানে পরবর্তীতে মার্বেল পাথর বসানো হয়েছে, যা আমাদের পরামর্শে নয়। একটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের আমদানি করা মার্বেল পাথর বসানোর সুযোগ দিতেই এটা করা হয়েছিল। এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে, দিনের বেলায় এখন আর ওখানে হাঁটা যায় না। রোদের কারণে যে পরিমাণ তাপ সৃষ্টি হয় তাতে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। পরবর্তীতে আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম সেখানে মাঝে মাঝে মার্বেল তুলে সবুজ ঘাস লাগাতে। যাতে কিছুটা হলেও এই সমস্যাটা কমে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন যে উন্নয়ন পরিকল্পনা দেখছি, তাতে রয়েছে টাইলস লাগানো, ইট লাগানো। এর সবই প্রচুর পরিমাণে তাপ তৈরি করবে। আবার এর জন্য গাছও কাটা হবে। গাছ তো শুধুই একটি গাছ নয়। এটা একটা অক্সিজেন তৈরির প্ল্যান্ট। সে অক্সিজেন তৈরি করছে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নিচ্ছে। অর্থাৎ বিনামূল্যে বিষ টেনে নিয়ে অক্সিজেন দিচ্ছে। অথচ, সেই গাছ আমরা কেটে ফেলছি কারো ইট আবার কারো টাইলসের মার্কেটিং করার জন্য। অন্তত পরিকল্পনাটি দেখে আমার তাই মনে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাঁটার রাস্তায় টাইলস বসালে সেটা তো গাছ রেখেও বসানো যেতে পারে। সেটা করা হলে বরং সূর্যের আলোর কারণে এই টাইলস থেকে আর তাপ উৎপন্ন হবে না।’
এই উদ্যানে গাছ লাগানোর প্রারম্ভিক সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পিডব্লিউডি থেকে প্রথম ল্যান্ডস্কেপিংয়ের ওপর পড়াশোনা করে এসে একজন স্থপতি এই উদ্যানে গাছ লাগানোর পরিকল্পনাটা তৈরি করেছেন। সে সময় আমিও ছিলাম তার পাশে। কোথায় কোন গাছ হবে, গাছগুলোর একটি থেকে অপরটির দূরত্ব কেমন হবে, কোন গাছের পাতা কতটা ছড়াবে, এভাবে তিনি এই পরিকল্পনা করেছিলেন। তার পরিকল্পনায় এই উদ্যানটি ছিল ঢাকার হৃৎপিণ্ড। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি নিজে দাঁড়িয়ে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। গ্লাস টাওয়ার তৈরির জন্য ইতোমধ্যেই আমরা অনেক গাছ কেটেছি। সেই অভাবটাও চারপাশের গাছ দিয়ে কিছুটা সমন্বয় করা সম্ভব। কিন্তু, রেস্টুরেন্ট আর গ্যাদারিং করার জন্য গাছ কাটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে কেন? গাছের নিচে মানুষ বসতে পারে না? গাছগুলোর চারপাশেই তো বসার ব্যবস্থা করা সম্ভব।’
‘গাছ কাটা একটি প্রচণ্ড রকমের অন্যায় কাজ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে হয়তো গাছ কাটতে বলেছে ১০টি, তারা কাটছে ২০০টি। এর বড় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে গাছগুলো কাটার পর সেগুলো লুকিয়ে রাখার মধ্যে দিয়ে। যেখানে গাছগুলো কাটা হয়েছে তার থেকে অনেক দূরে নিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখা হচ্ছে। প্রায় ৫০ বছর সময় লেগেছে এই গাছগুলো আজকের অবস্থানে আসতে। অথচ, কয়েকদিনের মধ্যেই তা কেটে ফেলা হলো’, বলেন তিনি।
কাজটি গণশুনানির মাধ্যমে শুরু করা উচিত ছিল জানিয়ে স্থপতি মোবাশ্বের বলেন, ‘গণশুনানি হলে সেখানে বিভিন্ন পরামর্শ আসত। আমরা বলতে পারতাম, এটা এভাবে না করে ওভাবে করা যায়। গাছ রেখে কীভাবে এই কাজটি করা যায় সে পরামর্শ দেওয়া যেত। রেস্টুরেন্ট যদি করতেই হয়, এই গাছের ফাঁকে ফাঁকেই খড় দিয়ে বা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা যেত। মানুষ সেটাকে স্বাগত জানাত। আমাদের স্থপতিরা বাঁশের স্থাপনা তৈরি করে আগা খান পুরস্কার জিতেছে। আল্লাহ বাংলাদেশকে এতো ঐশ্বর্য দিয়েছে যা কল্পনা করা যায় না। আমরা সেগুলোকে শুধুই ধ্বংস করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এসব বিষয়ে যে কমিটি হয়, তার প্রধান হন সরকারের উচ্চপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা। তিনি হয়তো কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা অন্য যেকোনো মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। হঠাৎ এখন তিনি হয়ে যান স্থপতি, হঠাৎ করেই হয়ে যান প্রকৌশলী। এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
গাছ কেটে ফেলায় পরোক্ষভাবে আরও কী কী ক্ষতি হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবাই এটাকে শুধু গাছ কাটা হিসেবে দেখছে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এটা আরও বেশি কিছু। কারণ, এখানে গাছ কেটে কংক্রিট বসানোর ফলে বৃষ্টির পানি আর মাটির নিচে যেতে পারছে না। এমনিতেই ঢাকায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। যদি এভাবে মাটির নিচে পানি পৌঁছানোর সব পথই বন্ধ হতে থাকে, তাহলে তো বিপদ আরও বাড়বে। বিষয়টি এমন, গাছ কেটে যদি ১০০টি পাপ করে থাকে, সেখানে আবার কংক্রিট বসানোর কারণে পাপের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৫০০টিতে। শুধু তাই নয়, এখানে এই কংক্রিটের ব্যবহার হওয়ায় চাইলেও গাছ কাটার পরে আবার গাছ লাগাতে পারবে না।’
যাদের পরিকল্পনায় এত বড় ক্ষতি হচ্ছে তাদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু সামনে যে থাকে তাকে শাস্তি দেই। কিন্তু দেওয়া উচিত তাকে যার পরামর্শে এমন অন্যায় কাজ শুরু হয়। আমি প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি, আপনাকে যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে এসব কাজ করায়, শুধু তাদের শাস্তির আওতায় আনেন। তাহলেই সমাধান আসবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। আপনি যদি লন্ডনে যান, সেখানে আধঘণ্টা হাঁটলেই পার্কের দেখা পাবেন। সেগুলো অত্যন্ত চমৎকার, সবুজ। ঢাকায় এর চেয়ে বেশি পার্ক থাকা উচিত। কারণ, এখানে মানুষের ঘনত্ব অনেক বেশি। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। আমি যখন ছাত্র, তখন এই উদ্যানটি বেশ সবুজ ছিল। সময় যত যাচ্ছে, এই উদ্যানের গাছ কেটে যোগ করা হচ্ছে কংক্রিট। স্বাধীনতা স্তম্ভ তৈরির সময় কতটা কম কংক্রিট ব্যবহার করা যায়, তা ভাবার সুযোগ ছিল। এর ভেতরে একটা মন্দির আছে, পুলিশেরও একটা জায়গা আছে। এখন আবার রেস্টুরেন্ট তৈরির জন্য গাছ কাটতে হচ্ছে। উদ্যানের ভেতরে রেস্টুরেন্ট কেন বানাতে হবে?’
ভবিষ্যতে এমন স্থাপনা তৈরি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কদিন পর বলবে, এখানে যেহেতু মেট্রোরেলের স্টেশন আছে, সেজন্য উদ্যানের ভেতরে গাছ কেটে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা তৈরি করা দরকার। এর সব কিছুই আমার কাছে মনে হচ্ছে মেট্রোরেলের প্যাকেজ। ভবিষ্যতে হয়তো এই উদ্যানটি আর উদ্যান থাকবে না। এটা শপিংমল, গাড়ি পার্কিং, রেস্টুরেন্ট এসব দিয়ে ভরে যাবে। এই মেট্রোরেলের জন্যই টিএসসি ভাঙার চিন্তা করা হচ্ছে। তার মানে পুরো এলাকাটাই একটা বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হতে পারে। যারা মেট্রোরেলে আসবেন, তাদের শপিং করার প্রয়োজন হতে পারে, থাকার জায়গার প্রয়োজন হতে পারে, খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এর সব ব্যবস্থাই তো এখানে করতে হতে পারে।’
অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী থাকে। তাদের জন্যই তো এই উদ্যান সবুজ রাখা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে গাছ আছে, সেগুলোও তো নতুন নতুন বিভাগের জন্য ভবন তৈরি করতে গিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে। গিয়াসউদ্দিন ভবন যেখানে হয়েছে, আমরা ছাত্র থাকা অবস্থায় সেখানে গাছ দেখেছি। এটা এখন শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তো বটেই, এখন পাশের উদ্যানটাও আমরা নষ্ট করে ফেলছি। উদ্যানকে উদ্যানের মতোই থাকতে দেওয়া উচিত। এর ভেতরে কংক্রিট ঢোকানো মোটেই উচিত না। বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, নতুন করে কীভাবে আরও গাছ লাগানো যায়। তা না করে উল্টো গাছ কাটছি। একটা গাছ বড় হতে কতগুলো বছর লাগে! হুট করে নেওয়া একটা সিদ্ধান্তেই সেগুলো কেটে ফেলা যায়? সেগুলো কেটে ফেলা কি কোনোভাবেই উচিত?’
দেশটা ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এখানে নেই। তারা থাকলে আরও আন্দোলন হতো এটা নিয়ে। সেই সুযোগ তো অবশ্যই তারা নিচ্ছে। সব সময়ই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য এক শ্রেণির মানুষ ওত পেতে থাকে। এই রেস্টুরেন্টগুলো কাদের বরাদ্দ দেওয়ার জন্য গাছ কাটার মতো এমন গর্হিত কাজ করা হচ্ছে, সেটাও জানা দরকার।’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের না হলেও এটা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই উচিত ছিল এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো। আর এ বিষয়ে যে পরিমাণ ভার্চুয়াল প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল, তাও চোখে পড়ছে না। গাছ কাটা কোনোভাবেই উচিত না। আমাদের উচিত ঢাকার ভেতরে জায়গা খুঁজে আরও গাছ লাগানো। তা না হলে এই অন্যায় কাজের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না’, যোগ করেন অধ্যাপক মামুন।
Comments