সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আহত কেন?

৪১০ বছরের এক প্রাচীন উদ্যান
বাংলাদেশের প্রাচীন উদ্যান কোনটি? কিংবা এমন স্মৃতিময় ঐতিহাসিক উদ্যানগুলোর কয়টি আজ টিকে আছে? হতে পারে উয়ারী-বটেশ্বর, ভিতরগড়, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, বিক্রমপুর, জৈন্তিয়া বা ধূমঘাটে গড়ে উঠেছিল অবিস্মরণীয় সব উদ্যান। কিন্তু আজ সেসবের কোনো অবশেষ নেই।
১৮৯৪ সালে উদ্যানবিদ ঈশ্বরচন্দ্র গুহ জামালপুরে ৪৫ বিঘা জমিতে ‘চৈতন্য নার্সারী’ নামে এক কৃষিভিত্তিক গবেষণা উদ্যান ও নার্সারি গড়ে তুলেছিলেন। এর কোনো চিহ্নই আজ নেই, এখানে এখন জামালপুর ফায়ার সার্ভিস। দেশে সুপ্রাচীন উদ্যানগুলোর খুব কমই আজ টিকে আছে। যদিও চৈতন্য নার্সারির বহু আগে ১৮০০ শতকে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গড়ে ওঠে বিপিন পার্ক। পার্কটি এখনো আছে, কিন্তু এর সেই প্রাচীন বাস্তুসংস্থান আর উদ্ভিদবৈচিত্র্য কিছুই আজ নেই। গাজীপুরের বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯০৯ সালে ঢাকার ওয়ারীতে গড়ে তোলেন ‘বলধা গার্ডেন’। জমিদার মঙ্গল চাঁদ চুনিলাল খুলনায় প্রায় চার বিঘা জমিতে ১৯২৮ সালে গড়ে তোলেন বিশেষ উদ্যান ‘প্রেমকানন’। ১৯৬১ সালে ঢাকার মিরপুরে প্রায় ২০৮ একর জায়গায় গড়ে তোলা হয় ‘জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান’। প্রেমকানন, বলধা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে কিন্তু টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। তাহলে দেশে বিনে পয়সার প্রাচীন উদ্যান কোনটি? যেখানে সকল শ্রেণি-পেশা ও বর্গের মানুষ বিনেপয়সায় প্রবেশের অধিকার রাখে? নিঃসন্দেহে ৪১০ বছরের প্রাচীন ঢাকার সোহরাওয়াদী উদ্যান ও রমনা পার্ক। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে যে উদ্যানে মিশে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দৃঢ় স্মৃতি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক সবুজ বলয় আজ আহত কেন? কার পরিকল্পনায়? কার স্বার্থে?
নিদারুণভাবে দুনিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই উদ্যান আজ উন্নয়নের যন্ত্রণায় কাতর। প্রবীণ বৃক্ষদের কেটে রেস্টুরেন্ট ও ওয়াকওয়ে বানানোর কথা শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছে চল্লিশের মতো বড় গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, অশোক, বকুল, সাদা রঙ্গন, জারুল, গগন শিরিষ, মেহগনি, সেগুন গাছ কাটা পড়েছে। বড় গাছগুলোতে টিকে থাকা পরাশ্রয়ী গুল্ম, চিলে বা বাস্কেট ফার্ণ, শৈবাল, লাইকেন, অণুজীব, পতঙ্গের সংসারও তছনছ হয়েছে। গাছ থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ভুবন চিলের বাসা, বসত হারিয়েছে অনেক পাখি ও প্রাণীরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে তর্ক উঠেছে। উন্নয়নের নামে গাছ কেটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক এবং সাংষ্কৃতিক চরিত্রকে চুরমার করা যাবে না। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, বাস্তুসংস্থান, ঐতিহাসিক ভাবগাম্ভীর্য সুরক্ষিত রেখেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ‘পাবলিক উদ্যান’ হিসেবে বিকশিত করতে হবে। আজকের এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাচীন রমনা কোনোভাবেই কেবলমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাস নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও এই উদ্যান গুরুত্ববহ। দুনিয়ায় খুব কম দেশেই ৪১০ বছরের কোনো ‘পাবলিক উদ্যান’ টিকে আছে। চীনের সুজো উদ্যান (৬ষ্ঠ শতক), ইতালির ওরটো উদ্যান (১৫৪৫), পারস্যের ফিন উদ্যান (১৫৯০), ফ্রান্সের জারডিন্স উদ্যান (১৫৯৩), যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড উদ্যান (১৬২১) ও রয়েল উদ্ভিদ উদ্যান (১৬৭০), যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি উদ্ভিদ উদ্যান (১৮৫৯) এসব প্রাচীন উদ্যানের মতোই ঢাকার রমনাও (১৬১০) সুপ্রাচীন। আমরা কি পারি গাছ কেটে, পাখিদের তাড়িয়ে অপরিকল্পিত স্থাপনা বানিয়ে এই উদ্যানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিবেশের সাথে জনমানুষের স্মৃতিময় সম্পর্ক মুছে দিতে?
সোহরাওয়ার্দী কীভাবে ‘পাবলিক উদ্যান’ হয়ে উঠলো
১৬১০ সালে বিহারের রাজমহল থেকে সুবা বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয় ঢাকায়। সেই মুঘল শাসনের সময়েই বিস্তীর্ণ রমনা অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় উদ্যান ‘বাগ-ই-বাদশাহি’। রমনা হয় ওঠে বনেদী অভিজাতদের এক বিলাসী উদ্যান। ১৭১৭ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে নেওয়া হয়। বাদশাহি বাগান থেকে রমনা ধীরে ধীরে এক বুনো উদ্যান আর বন্যপ্রাণীর আবাস হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ১৮২৫ সালে ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস ঢাকা জেলের কয়েদিদের দিয়ে দক্ষিণ অংশে ঘোড় দৌড়ের জন্য ‘রেসকোর্স’ তৈরি করেন। রেসকোর্স ঘিরে রমনা আবারো অভিজাতদের ‘রমনা গ্রিন’ নামের উদ্যান হয়ে ওঠে।
১৮৪০ সালের দিকে বনেদীরা এখানে বাগানবাড়ি করতে থাকেন। নবাবেরা সেসময় এই এলাকার নাম রাখেন ‘শাহবাগ’। ১৮৪০ সালে উদ্যানের কোণে গড়ে ওঠে ‘ঢাকা ক্লাব’। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের পর বিশাল রমনা অঞ্চলও তিন টুকরো হয়ে যায়। রেসকোর্স ও বর্তমানের রমনা উদ্যান মিলিয়ে একটি অংশ, শাহবাগ এবং মিন্টো রোডের আবাসিক এলাকা। দীর্ঘদিন রমনার দক্ষিণ অংশ রেসকোর্স হিসেবেই পরিচিত ছিল। রমনা উদ্যানের পাশে একসময় একটা চিড়িয়াখানাও তৈরি হয়েছিল। এভাবেই বিশাল রমনা অঞ্চল ৩৫০ বছর ধরে কেবলি বনেদী আর অভিজাতদের বিলাসী অঞ্চল হিসেবেই ‘বন্দি’ হয়ে ছিল। জনমানুষের প্রবেশাধিকার ছিল প্রায় রুদ্ধ। এখন আমরা কী দেখি? একদিকে রমনা পার্ক আরেকদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। প্রতিদিন এখানে ঘুরে বেড়ায় কত গরিব ভাসমান মানুষ। সকল শ্রেণি-পেশা-বর্গের মানুষ এখানে আসতে পারছে। কীভাবে একদার এই অভিজাত এলাকা আজকের এই পাবলিক উদ্যান হয়ে উঠলো? বঙ্গবন্ধুই প্রথম রমনাকে ধনী-গরিব সকলের জন্য মুক্ত করেন। ১৯৬৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রমনা রেসকোর্সেই বিশাল গণসংবর্ধনা পান শেখ মুজিবুর রহমান। এই মাঠেই তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয় আর রমনা উদ্যানে বাড়তে থাকে জনমানুষের চলাচল। ৫ জুন বিশ্বব্যাপি বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। জুন মাস দেশব্যাপি বৃক্ষমেলা আর বৃক্ষরোপণের মাস। দেশ স্বাধীনের পর এমনি এক জুন মাসে বঙ্গবন্ধু এই উদ্যানে নানা প্রজাতির চারা রোপণ করেন। রমনা রেসকোর্সের নাম দেন ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’। আর তখন থেকেই রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ‘পাবলিক উদ্যান’ হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিবার্তা ও বিষন্ন গগন শিরিষ
রমনার প্রবীণ বৃক্ষ বল্কল আর মাটির বলয়ে বইছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্রোত। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই রচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। উদ্যানের প্রবীণ গাছের বর্ষবলয়ে এখনো সেই সাহসী আওয়াজ টানটান হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের বিশাল সমাবেশ হয় এখানে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকসেনারা আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করে এখানেই। দেশ স্বাধীনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ এই উদ্যানে আয়োজিত বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেন। গণঅভ্যুত্থান, ভাষা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার স্বাক্ষী এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এখানকার বহু গাছ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ স্পর্শ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে। ফরিদপুর ভাঙ্গার নাসিরাবাদের আবদুল্লাহপুর গ্রামের হুমায়ুন ফকির (৮০) সব হারিয়ে ঢাকায় আসেন। কবিরাজি আর দিনমজুরি করে দিন কাটান। প্রায় ৬৫ বছর ধরে তিনি রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় আছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর বৃক্ষরোপণের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এখানে দুটি নারিকেল, দুটি তেঁতুল, দুটি ছাতিয়ান এবং একটি বেলের চারা রোপণ করেছিলেন। উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা প্রবীণ এক বকুল গাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গতকাল উদ্যানের ভেতর কথা হয় হুমায়ুন ফকিরের সাথে। তিনি বলেন, ‘গাছ থাকলে আমি মনের ভিতরে ফূর্তি পাই, তারা কেন যে বেহুদা গাছ কাটতেছে এর মর্ম বুঝতেছে না।’ হুমায়ুন ফকিরের কাছে এইসব গাছ যেন এক একটি জীবন্ত টগবগে স্মৃতিময় দলিল। বঙ্গবন্ধুর বৃক্ষ-স্মৃতি তার বুক ভিজিয়ে দেয়। শিখা চিরন্তনের উল্টোদিকের এক মাঝবয়েসী বট গাছ দেখিয়ে বলেন, ‘এটি খুলনার হুমায়ুন সাধু লাগাইছে, আমারে কইয়া গেছে এর যত্ন নিবি।’
করোনা মহামারির ভেতর সরেজমিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর বহু কাটা গাছের গুঁড়ি আর চুরমার হওয়া পাখির বাসা দেখে খুব বিষন্ন লাগে। নাটোরের উত্তরা গণভবনে (দিয়াপতিয়া রাজবাড়ি) বঙ্গবন্ধু বিরল এক হৈমন্তী গাছের চারা লাগিয়েছিলেন, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে রোপণ করেছিলেন নারিকেল চারা। সেসব গাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর যে স্মৃতি গুঞ্জরিত তা আর কোথায় আছে? কারণ এখানেই উচ্চারিত হয়েছে, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিবার্তার বিশেষ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা এই উদ্যানের সকল প্রাণ-প্রজাতিকে সুরক্ষিত রেখেই আমাদের এখানকার উয়ন্নন পরিকল্পনা করতে হবে। এই উদ্যানের জন্য ইতিহাস ও প্রকৃতি সংবেদনশীল বিশেষ স্থাপত্য নকশা করতে হবে। বাহাদুরি করে অনেক কিছু করা যায় অন্য কোথাও, পৃথিবীর এতো সুপ্রাচীন এক নগর উদ্যানের সাথে কেন? দেশের জন্মভ্রুণের সাথে জড়িয়ে থাকা এখানকার মাটি, বৃক্ষ, বুনোপ্রাণ আর বাস্তুসংস্থানকে বিরক্ত করে কেন?
সাতই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কেবল ভৌগলিক মুক্তি নয়, আমাদের মনস্তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতার কথাও বলেছেন। গাছ কেটে, পাখিদের তাড়িয়ে কিছু মানুষের জন্য রেস্টুরেন্ট (বা ফুড কিয়স্ক) বা অপরিকল্পিত স্থাপনা বানালে মানুষ হিসেবে আমাদের মনের মুক্তি কি মিলবে? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাটা গাছের গুঁড়ি থেকে ঝরছে উন্নয়ন যন্ত্রণার রক্ত-কষ। জেলে থাকাকালীন দুই হলদে পাখির সাথে সখ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর। বেশ কয়েকদিন পাখি দুটি না আসাতে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই ভালোবাসার কথা কি আমরা নতুন প্রজন্মকে জানাতে পেরেছি? বরং আজকে ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্প’ বাস্তবায়নের নামে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত এই উদ্যানের গাছ কেটে ফেলছি। তাহলে নতুন প্রজন্ম এখান থেকে কী শিখবে? কিংবা আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস কিংবা স্মৃতি হিসেবে কী তুলে ধরতে চাইছি? কিছু কংক্রিটের স্থাপনা? গাছ, প্রাণবৈচিত্র্য, উদ্যানের সাথে মানুষের প্রতিদিনের স্মৃতিকথা এমন সবকিছুই তো ইতিহাসের অংশ। এসব রেখে এবং গাছ-পাখিসহ জীবন্ত সব দলিলের উপস্থিতি রেখেই এই উদ্যানকে সত্যিকারের ‘স্বাধীনতা স্মৃতি উদ্যান’ হিসেবে বিকশিত করা সম্ভব। আর এর জন্য দরকার সকল শ্রেণি-পেশা-বর্গের নাগরিকদের সাথে পরামর্শ এবং সমন্বয়। এই উদ্যানের সকল স্মৃতি দেশের মানুষের রক্তপ্রবাহে গুঞ্জরিত, এটি একটি পাবলিক উদ্যান। মানুষই তো এখানে আসবে, মানুষই তো এই স্মৃতিকে সংরক্ষণ করবে, বহন করবে এবং আগলে দাঁড়াবে। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কথা বলবার, প্রশ্ন করবার, পরামর্শ দেয়ার, সহযোগিতা করবার অধিকার দেশের সকলেরই আছে। কেটে ফেলা গাছ এবং উচ্ছেদ হওয়া পাখিরাও কিন্তু এই উদ্যান এবং দেশের অংশ। কেবল মানুষ নয়, আসুন বৃক্ষ-পাখিদের আয়নাতেও বিবৃত এই মহাপরিকল্পনাকে দেখার চেষ্টা করি। উন্নয়নের নামে মাটিতে চুরমার হওয়া ভুবন চিলের বাসা দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন হয়, জেলে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর সেই হলুদ পাখিদের স্মৃতি কেন যেন খুব মনে পড়ে যায়।
সেচি শাক, অশোক-বকুল আর আমের গল্প
টিএসসির দিকের বেষ্টনীর বিপরীতে গাছের ছায়ায় বসে মালা গাঁথছিলেন বেশ কয়েকজন নারী, শিশু ও পুরুষ। শরিয়তপুরের জাজিরার গোপালপুরের বরুণী ও দইল্যা মাতবরের কন্যা ফিরোজা বেগম (৬০) প্রায় বিশ বছর ধরে আছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। উদ্যান থেকে ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে বিক্রি করেন। তার মেয়ে মুক্তা বেগম। মুক্তা বেগমের ছেলে মেহেদী হাসান (২৪)। মেহেদী জানায়, তার বড় হওয়া এই উদ্যানেই। এখানে প্রায় ৭০/৮০ জন প্রতিদিন উদ্যান থেকে ফুল, মৌসুমি ফল, জ্বালানি লাকড়ি কুড়িয়ে জীবন ধারণ করেন। প্রতিদিন ২০০/৩০০ টাকার ফুল ও ফুলের মালা বেচা যায়। করোনা মহামারী এবং উদ্যানের সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রকল্প তাদের এই উদ্যান নির্ভর জীবনকে একেবারেই বদলে দিয়েছে।
ময়মনসিংহ সদরের মো. শাহজাহান (৪৮) প্রায় ৮ বছর ধরে এই উদ্যানে আছেন। তিনি জানান, তাদের মতো ঘরহীন ভাসমান উদ্যানের মানুষের ভেতরের আম-জাম-কাঁঠাল খেতে পারতো তবে এই করোনাকালে পারবেন কী না কে জানে। অনেক গাছ কাটা পড়েছে আবার অনাবৃষ্টির কারণে মুকুল ঝরে পড়েছে। কাঁঠালিচাপা, সাদা রঙ্গন, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালীলতা ফুল বেশি কুড়ায় শিশু ও নারীরা। মো. শাহজাহান জানালেন, নাগিন গাছের (কাঁঠালি চাপা) ফুলের দাম বেশি। ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশা থেকে আসা একজন দিনমজুর জানান, অনেকে উদ্যান থেকে নাগেশ্বর ও অশোক ফুল নিয়ে শুকিয়ে সাধনা কোম্পানির কাছে ওষুধ বানানোর জন্য বিক্রি করে। অনেক মানুষ সকালে হাঁটতে এসে তেলাকুচা পাতা তুলে নিয়ে যায়। একটা নিচু জায়গায় বসে কুড়ানো লাকড়ি দিয়ে রান্না করছিলেন মো. নূর (৪৫), তার স্ত্রী জাহানারা বেগম (৪০) উদ্যান থেকেই কুড়িয়ে এনেছেন সেচি শাক। জাহানারা জানান, এখন কয়েক মাস যখন এইসব গাছ কাটা শুরু হইছে তখন এই শাকও তুলবার দেয় না, খেদাইয়া দেয়। নূরের পরিবার নদীভাঙ্গনে ঘর হারিয়ে ভোলার লালমোহন থেকে ঢাকায় এসে প্রায় ১০ বছর ধরে এখানে আছেন। একটুখানি শ্বাসফেলার মুক্তাঙ্গন, শহরের ফুসফুস, অক্সিজেন কারখানা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ শিশু-প্রবীণ-প্রতিবন্ধী মানুষের হাঁটাচলা কী শরীরচর্চার স্থান, চিত্তবিনোদন-ইতিহাস-ঐতিহ্য সুরক্ষিত অঞ্চল কেবল নয়, ফিরোজা কী জাহানারাদের মতো অনেক মানুষের কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বেঁচে থাকবারও একমাত্র উৎসস্থল। এই উদ্যানের প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করেই কোনো না কোনোভাবে আরো চেয়েচিন্তে বা দিনমজুরি করে এদের সংসার চলে। এখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বট, অশ্বত্থ, কাঁঠাল, জাম, বকুল, অশোক, নাগেশ্বর, কদম, কদবেল, একাশিয়া, নারিকেল, শিশু, রেন্ট্রি, কড়ই, জারুল, দেবদারু, কাঁঠালিচাপা, পাম, গগন শিরিষ গাছ আছে। আর এর ওপর কেবল পাখি বা পতঙ্গ নয়, বেঁচে থাকছে কিছু মানুষও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত স্বাধীনতা স্তম্ভ ‘শিখা চিরন্তনের’ দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু চিরকাল এই মেহনতি গরিব মানুষের সুরক্ষার কথা বলেছেন।
স্মারক বৃক্ষ ও স্মারক অঞ্চলের দাবি
সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ণ করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’’। তাহলে উন্নয়নের নামে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবীণ গাছদের কাটতে পারি কি? ভুবন চিল, চড়ুই, শালিক, কাক, বেজি, গুইসাপ, গিরগিটি, প্রজাপতি, ভ্রমর, মৌমাছি, গুল্মলতা, লাইকেন, শৈবাল এদের নিরাপত্তা কে দেবে? এখানে একটি ছোট এলাকায় যে বিশেষ বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়েছে সেটি সংরক্ষণ করবে কে? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই উদ্যানের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধীর সমাবেশসহ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্মৃতি সংরক্ষণ করতে চায়। স্মরণে রাখা জরুরি এই উদ্যানের বৃক্ষ ও বাস্তুসংস্থান সকলেই এসব স্মৃতির উত্তরাধিকার বহন করছে। এসব গাছ না কেটে বরং দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এসব গাছকে ‘স্মারক বৃক্ষ’ হিসেবে সংরক্ষণ করা জরুরি। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী ‘স্মারকবৃক্ষ’ মানে হলো সেসব গাছ যা ঐতিহ্যবাহী বৃক্ষ বা পুরাতন বয়স্ক দেশীয় উদ্ভিদ বা শতবর্ষী বৃক্ষ যার যথেষ্ট সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সংরক্ষণ মূল্য রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষকূল ১৯৬৯ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অতন্দ্র স্বাক্ষী। ৪১০ বছর ধরে এই উদ্যানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছের স্মারকবৃক্ষ হিসেবে সংরক্ষণ করা হোক, রমনা-সোহরাওয়ার্দী মিলিয়ে এই বিশেষ পাবলিক উদ্যান অঞ্চলকে ‘সবুজ স্মারক অঞ্চল’ হিসেবে সুরক্ষিত করা হোক। বলধা থেকে ওসমানী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী হয়ে রমনা পার্ক টিকে থাকা ঢাকার এই বিশেষ সবুজ বলয় আমাদের সকলের টিকে থাকার জন্য জরুরি।
পাভেল পার্থ, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক।
Comments