বিপজ্জনক বুড়িগঙ্গার সংকীর্ণ বাঁক
দেশের নৌপথের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর ফতুল্লার বাঁকের অংশটি সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। বাঁকের অংশটিতে কিছু দিন পর পরই ঘটছে দুর্ঘটনা। ডুবছে নৌযান, ঘটছে প্রাণহানি।
নৌপরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বাঁকের এই অংশে নদীর দুই পাশে অবৈধভাবে ভরাটের কারণে নৌপথ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় বেড়েছে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া, নদীর এই সংকীর্ণ অংশে জাহাজ নোঙ্গর করে রাখা এবং প্রশিক্ষণবিহীন চালক চালিত বালুবাহী নৌযানকেও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করেন তারা।
বুড়িগঙ্গার বাঁকের পূর্ব দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা এবং পশ্চিম দিকে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার কোন্ডা ইউনিয়নের কাওটাইল। বুড়িগঙ্গা নদী কামরাঙ্গীরচর থেকে চকবাজার, সদরঘাট, পোস্তগোলা হয়ে ফতুল্লা পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব দিকে প্রায় সোজা এগিয়েছে। ফতুল্লায় এসে ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো একটি বাঁক নিয়েছে, তারপর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ধলেশ্বরীতে গিয়ে মিশেছে।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বুড়িগঙ্গার প্রবাহপথে বর্তমানে সবচেয়ে সংকীর্ণ খাত হচ্ছে ফতুল্লার বাঁকের অংশটি।
গত তিন বছরে ঘটেছে অনেকগুলো দুর্ঘটনা
চলতি বছর জানুয়ারিতে যাত্রীবাহী কীর্তনখোলা-১০ ও এমভি ফারহান-১০ লঞ্চের সংঘর্ষ হয়। একই জায়গায় গত বছরের মার্চে গ্রিন ওয়াটার-১০ নামে একটি লঞ্চ সদরঘাট থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ফতুল্লায় পৌঁছলে একটি বালুবাহী ট্রলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে লঞ্চটির তলা ফেটে যায়। তবে, লঞ্চটি চরে ভেড়ানোয় যাত্রীরা প্রাণে বেঁচে যান।
তবে, গতবছর ৩ জানুয়ারি ফতুল্লায় লঞ্চের সঙ্গে বালুবাহী ট্রলারের সংঘর্ষে ট্রলারের ৩ জন প্রাণ হারান।
একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালের ১০ মার্চ, ১৯ এপ্রিল এবং ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি ও ১৮ আগস্টেও।
বুড়িগঙ্গার সংকীর্ণ বাঁক সম্পর্কে সুন্দরবন ১৪ লঞ্চের ইনচার্জ মাস্টার আলতাফ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বুড়িগঙ্গার ফতুল্লায় বাঁকে আপের লঞ্চ ডাউনের নৌযান দেখতে পারে না। আবার ডাউনের লঞ্চ আপের নৌযান দেখতে পায় না। ফলে এখানে খুব সাবধানে লঞ্চ চালাতে হয়। লঞ্চ চালকরা সাধারণত ফতুল্লার বাঁক অতিক্রম করার সময় মাইকে ঘোষণা দিতে দিতে বাঁক অতিক্রম করে।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌ চলাচলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদজনক অংশ হচ্ছে ফতুল্লার বাঁকের অংশটি। বুড়িগঙ্গা নদীর দুপাশে অবৈধভাবে ভরাট করার কারণে নৌপথ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। মূলত নৌপথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ায় সেখানে বার বার নৌ দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়াও, বাঁকে বিভিন্ন জাহাজ নোঙ্গর করে রাখা হয় বলেও জানান তিনি।
সুন্দরবন-১০ লঞ্চের সহকারী মাস্টার মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ‘লঞ্চ চালকরা খুব সতর্কতার সঙ্গে বাঁকটি অতিক্রম করে। ফলে বাঁকটিতে লঞ্চে লঞ্চে সাধারণত সংঘর্ষ হয় না। সংঘর্ষ হয় লঞ্চের সঙ্গে বালুবাহী ট্রলারের অথবা যাত্রীবাহী বা পণ্যবাহী ট্রলারের সঙ্গে বালুবাহী ট্রলারের।’
নদী তীর অবৈধ দখল
ফতুল্লায় নারায়ণগঞ্জ-পোস্তগোলা মহসড়ক ছিল বুড়িগঙ্গার তীরে। তবে এখন বুড়িগঙ্গা সড়ক থেকে বেশ দূরে।
সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁকের অংশে গিয়ে দেখা যায়, মহাসড়ক ও লঞ্চ ঘাটের মধ্যে নদীর অবৈধ ভরাটকৃত অংশে মার্কেট নির্মাণ করেছে সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ।
ফতুল্লা লঞ্চঘাটের উত্তর দিকে পোস্তগোলা-নারায়ণগঞ্জ মহাসড়ক সংলগ্ন নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থানটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গরুর হাট হিসেবে। প্রতি মঙ্গল বার সেখানে বসে সাপ্তাহিক হাট। গরুর হাটে স্থায়ী কোনো কাঠামো দেখা যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, ফতুল্লায় নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থানে উচ্ছেদ অভিযানে এখানকার স্থায়ী কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হয়। তবে, ভরাটকৃত স্থান খননের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বুড়িগঙ্গার ফতুল্লার বাঁকে সবচেয়ে বেশি অবৈধ ভরাটের শিকার নদীর পশ্চিম তীর। সেখানে সারিবদ্ধভাবে গড়ে উঠেছে কয়েকটি বড় শিপইয়ার্ড কোম্পানি। নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত অংশে চলে জাহাজ নির্মাণের কাজ। এ ছাড়াও, প্রতিটি শিপইয়ার্ড সংলগ্ন নদীতে জাহাজ ও কার্গো নোঙ্গর করা থাকতে দেখা যায়।
বুড়িগঙ্গার বাঁক তীরবর্তী কোন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাইদুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ নদীর তীরে সীমানা পিলার স্থাপন করেছে। স্থায়ী কাঠামো ভেঙ্গে ফেলেছে। কিন্তু, বুড়িগঙ্গার অবৈধভাবে ভরাটকৃত অংশ খনন করেনি। বুড়িগঙ্গার বাঁকের দুপাশে অবৈধভাবে ভরাট করা স্থান খনন করা হলে বাঁকের অংশের নৌপথটি অধিকতর নিরাপদ হবে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ড. আবু নাসের খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নদীর সীমানা প্রসঙ্গে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে ফতুল্লার নৌপথ নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হতে পারে। সিএস দাগ নম্বরের ভিত্তিতে ফতুল্লায় নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত অংশ খনন করা হলে নৌপথটি প্রশস্ত হবে।’
ড. আবু নাসের খান আরও বলেন, ‘ফতুল্লায় নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত অংশ থাকা মানে হচ্ছে ক্যান্সার নিয়ে জীবনযাপন করার মতো। ফতুল্লায় নৌপথকে নিরাপদ করতে হলে ভরাটকৃত অংশ খননের কোনো বিকল্প নেই।’
বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঢাকার সার্কুলার ওয়াটারওয়ে প্রকল্পের উপ-প্রধান পরিচালক মো. মতিউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, এ ব্যাপারে ঢাকা নদী বন্দরের বন্দর যুগ্ম পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মো. গুলজার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন।
মো. গুলজার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মো. জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন।
যুগ্ম পরিচালক (ট্রাফিক) মো. জয়নাল আবেদীনের মোবাইল ফোন নম্বরে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেনি। ফতুল্লায় নৌ-দুর্ঘটনা বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য এসএমএস পাঠানো হলে তিনি তার উত্তর দেননি।
Comments