করোনায় বিপর্যস্ত ভারত: দ. এশিয়াজুড়ে সংক্রমণ বাড়ছে

ভারতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও তা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিমের করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
Corona.JPG

ভারতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও তা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিমের করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে উল্লেখ করা হয়, এমতাবস্থায় নিজেদের দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব হবে না- এই শঙ্কা থেকে ভ্রমণসহ অন্যান্য বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দেশগুলো।

গত মার্চ থেকে ভারতে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে, এরপর তা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। 

একইসঙ্গে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করে, যদিও বিভিন্ন রুটের মাধ্যমে সেখানে ভাইরাস প্রবেশ করে।

এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল নানা প্রতিরোধ ব্যবস্থা জারি রাখলেও, এপ্রিল থেকে সেখানেও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। এখন সংক্রমণের দিক দিয়ে নেপালের বিষয়টি বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

রেডক্রসের বরাতে নেপাল সরকারের দেওয়া তথ্যমতে, সেখানকার ৪০ শতাংশের বেশি কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ।

নেপালেরে সঙ্গে ভারতের এক হাজার ৮৮০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত রয়েছে। এ ছাড়া, বহু মানুষ ব্যবসা, ভ্রমণ অথবা বিভিন্ন পারিবারিক কাজে নিয়মিত সীমান্ত অতিক্রম করেন।

ভারত সফরের পর কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছিলেন নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র। তবে, তিনি কোথা থেকে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

মার্চে নেপাল কর্তৃপক্ষ সীমান্তের ক্রসিংগুলোতে বাড়তি স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়। শেষ পর্যন্ত  ১ মে থেকে ২০টি প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এর আগে, গত ২৯ এপ্রিল কাঠমান্ডু ভ্যালি এলাকায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশেও মার্চের শুরু থেকে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এরপর তা বাড়িয়ে ১৬ মে পর্যন্ত করা হয়েছে।

গত ২৬ এপ্রিল থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহের জন্য ভারতের সঙ্গে স্থল বন্দরগুলো বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। যদিও অনেককেই এখনো সীমান্ত পার হওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

এরপর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করে বাংলাদেশের দৈনিক করোনা সংক্রমণের হার।

এদিকে, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আশঙ্কা সত্য হয়ে পাকিস্তানেও এখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বমুখী।

পাকিস্তানে এই মুহূর্তে জাতীয় পর্যায়ে কোনো লকডাউন না চললেও কিছু প্রাদেশিক রাজ্যে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কিছু এলাকায় এসব বিধিনিষেধ কার্যকর করতে দেশটির সেনা সদস্যরা কাজ করছেন।

এ ছাড়া, স্থল সীমান্ত পার হয়ে ভারত, আফগানিস্তান ও ইরান থেকে পাকিস্তান ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার।

মধ্য এপ্রিল থেকে শ্রীলঙ্কাতেও সংক্রমণ বাড়তে থাকে। যে কারণে বেশ কিছু এলাকার স্কুল বন্ধের পাশাপাশি ধর্মীয় সমাবেশ ও ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

সংক্রমণ কেন বাড়ছে?

আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আংশিকভাবে দায়ী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়ায়।

আবার এটাও হতে পারে যে, নতুন সংক্রমণের সঙ্গে অন্য কোনো জায়গার ভ্যারিয়েন্টের সংযোগ আছে। যেমন: যুক্তরাজ্যের একটি ভ্যারিয়েন্ট।

দুই মাস আগে নেপাল থেকে সংগ্রহ করা করোনাভাইরাসের ১৫টি নমুনা পরীক্ষার জন্য হংকংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত একটি ল্যাবে পাঠানো হয়। সেখানে দেখা গেছে, নমুনাগুলোর মধ্যে নয়টি যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট আর একটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট।

এপ্রিলে পাকিস্তানের করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে বেশিরভাগ নমুনায় যুক্তরাজ্যের ধরন পাওয়া যায়। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের সিন্ধু প্রদেশের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্টের খোঁজ পেয়েছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার ওই ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে।

উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে- এই এলাকাগুলোতে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হচ্ছে খুবই সীমিত পরিসরে। সুতরাং, ভাইরাসটির নতুন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের গতি বাড়াচ্ছে- এমনটি বলার জন্য যথেষ্ট উপাত্ত নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, সার্বিকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও পরীক্ষার হার অনেকটাই কমে গেছে। মাত্র ১০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে।

চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ অন্যদের অভিমত, করোনার বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে মিশ্র বার্তা আসতে থাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে মানুষের সচেতনতা কমেছে।

ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মুখে পাকিস্তানে চিকিৎসকরা সেখানকার হাসপাতালগুলোর সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে রীতিমতো সংগ্রাম করছেন। এ অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও স্বাস্থ্যবিধি তদারকিতে সেনাবাহিনীর যুক্ততার বিষয়ে তাদের অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করেন।

কেমন চলছে টিকাদান কার্যক্রম?

টিকাদান প্রক্রিয়ায় ধীরগতি একটা বড় উদ্বেগের বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কোভিডের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে সেই জানুয়ারি থেকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটা সেভাবে বিস্তৃত হয়নি। যা সত্যিকারের পার্থক্য তৈরি করতে পারে।

সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, নেপাল প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে টিকা দেওয়া হয়েছে সাত দশমিক দুই ডোজ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাঁচ দশমিক চার, শ্রীলঙ্কায় চার দশমিক আট, পাকিস্তান এক এবং আফগানিস্তান শূন্য দশমিক ছয় ডোজ।

যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে এই সংখ্যা প্রায় ৭৬। যুক্তরাজ্যে ৭৫। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ৩৭ এবং চীনে ২০ জনের বেশি।

ভারত সেরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেকের উৎপাদিত কিছু টিকা প্রতিবেশী দেশগুলোকে অনুদান হিসেবে দেয়। কিন্তু দেশে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মুখে নিজেদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সাময়িকভাবে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়।

এ ছাড়া, শিপমেন্টের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ায় বৈশ্বিক কোভ্যাক্স ভ্যাকসিন স্কিমের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টিও আছে।

চীনের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত নেপাল ও শ্রীলঙ্কা তাদের টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ রেখেছে।

পাকিস্তান তাদের টিকাদান কার্যক্রম গতি বাড়ানোর চেষ্টায় চীন ও রাশিয়া উভয় দেশের উৎপাদিত টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।

Comments