অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ও আমাদের সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ধর্মপরিচয়ে হিন্দু না মুসলমান— জানতামই না। এ প্রশ্নটি আমার মন ও মগজে জাগেওনি। মুগ্ধ হয়ে দেখি এই প্রতিভাবান মানুষটির অভিনয়। আহা! কী অসামান্য, কী দুর্দান্ত, কী জীবন-ঘনিষ্ঠ। কী মঞ্চে, কী টিভিনাটকে, কী রুপালি পর্দায়— সর্বত্র।
চঞ্চল চৌধুরী ও তার মা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ধর্মপরিচয়ে হিন্দু না মুসলমান— জানতামই না। এ প্রশ্নটি আমার মন ও মগজে জাগেওনি। মুগ্ধ হয়ে দেখি এই প্রতিভাবান মানুষটির অভিনয়। আহা! কী অসামান্য, কী দুর্দান্ত, কী জীবন-ঘনিষ্ঠ। কী মঞ্চে, কী টিভিনাটকে, কী রুপালি পর্দায়— সর্বত্র।

নীলক্ষেত সংলগ্ন বলাকা সিনেমা হলে যখন গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘মনপুরা’ সিনেমাটি মুক্তি পায়, ক্যাম্পাস থেকে দল বেঁধে দেখতে গেছি আমরা। সিনেমায় আছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। তার অভিনীত ‘টেলিভিশন’, ‘আয়নাবাজি’, ‘দেবী’ দেখেছি। অসংখ্য নাটকে তার অভিনয় দেখতে দেখতে ভেবেছি, একটা মানুষ এত বিচিত্র চরিত্রে এত সাবলীল, এত নিখাদ, এত পূর্ণাঙ্গ ও সম্পন্ন অভিনয় কীভাবে করতে পারেন!

পাবনার প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে উঠে আসা এ অভিনেতাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও দেখি অন্য অনেকের মতো শুধু চমক লাগানো পোস্ট নয়, বরং মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনার গল্পগুলো সাবলীল ভঙ্গিতে শেয়ার করেন। আগ্রহ নিয়ে পড়ি। ভালো লাগে। মনে হয়, এতো আমাদেরই চেনা গল্প। এতো গ্রাম আর মফস্বলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের শৈশব-কৈশোরের অভিন্ন স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা।

এদেশে রাতারাতি কিছু তারকাখ্যাতি পাওয়া অভিনেতা বা অভিনেত্রী সেসব ফেলে আসা দিন ভুলে যান বা মেকি একটা আলো ঝলমলে জগতের প্রাচীর তৈরি করে নিজেকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। যেন তাদের কোনো অতীত নেই। বর্তমানই একমাত্র সত্য। চঞ্চল দেখি এখানেও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এ শিক্ষার্থী বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকে শুরু করে অভিনয়, গান, ছবি আঁকা সব কিছুতেই যেন সমান পারদর্শী। ছাত্রাবস্থায়ই ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের জায়গা করে নেন।

সমাজ-সংসারে মানুষের মতো দেখতে কিছু অমানুষ আছে, তাদের মনে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় নয়, মেধা নয়, প্রতিভা নয়; সে হিন্দু না মুসলমান সে প্রশ্নই আগে জাগে। বিশ্ব মা দিবসে চঞ্চল চৌধুরীর মাকে নিয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে কতিপয় সাম্প্রদায়িক মন্তব্যে চঞ্চল চৌধুরী ব্যথিত হয়েছেন। আহত হয়েছেন। এই ব্যথা আমাদেরও ছুঁয়ে গেছে। ছুঁয়ে গেছে কেননা মানুষের সমাজ এখনো আমরা বিনির্মাণ করতে পারিনি বলে। এখনো কেবল ধর্ম আর রাজনীতির নিক্তিতে আটকা পড়ে যায় মানুষের পরিচয়। সাম্য ও সম্প্রীতির কবি নজরুল বিভক্তি ও বিদ্বেষের এই রাজনীতি দেখে মুক্তির ব্যাকুল বাসনায় সখেদে বলেছিলেন,

‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,

কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!

“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?’

ঔপনিবেশিক আমলের কূটকৌশলের রাজনীতি নয়, স্বাধীন দেশে আজও দেখি মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বদলে বিভক্তি। একমুখী নয়, বহুধা-বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা এই সাম্প্রদায়িক সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। মান নয়, পরিসংখ্যান আর কংক্রিট-উন্নয়নের জোয়ারে ঢেকে যাচ্ছে আমাদের মন ও মননের সব প্রগতি ও উন্নয়ন। অবিকশিত ও অবরুদ্ধ আমাদের মানবিক ও সাংস্কৃতিক জগত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এজন্য প্রায়ই কিছু মানুষের বিষেভরা নখদন্তের আঁচড় দেখা যায়।

এদেশে এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরিদীর মতো অভিনেতাদের সার্থক-উত্তরসূরি একজন চঞ্চল চৌধুরী। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার যেমন দেশের গর্ব, তেমনি চঞ্চলের মতো অভিনেতাও। দুই অঙ্গনের মানুষ হলেও তারা জাত-পাত ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের মানুষকে অভিন্ন অনুভূতির সুতোয় বাঁধেন। চঞ্চল চৌধুরী ও তার মায়ের জন্য নিরঙ্কুশ ভালোবাসা। এমন রত্নগর্ভা মায়ের জন্য অপরিমেয় শ্রদ্ধা। মা গো, তোমার ওই সিঁথির সিঁদুর দেখে যে মন্দ মন্তব্য করেছে, সে জানে না ও তোমার বিশ্বাসী সৌন্দর্য। তোমার অজস্র সন্তানেরা গায় সাম্যের গান। তারা বলে, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

লেখক : কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago