সাইবার বুলিংয়ের শেষ কোথায়, প্রতিকার কী?
রোববার প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয়ে সোমবার একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী সংখ্যালঘু হওয়ার আক্ষেপ করেছেন। তিনি নিজেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু দাবি করেননি, শিল্পী হিসেবে সংখ্যালঘু বলেছেন। এও বলেছেন- তার পরিচয় তিনি মানুষ এবং শিল্পী। তিনি দুঃখ পেয়েছেন তার ওপর আসা আঘাতে সতীর্থ শিল্পী-সমাজকে পাশে না পাওয়ার জন্য। বলেছেন— তার সঙ্গে যারা কাজ করেন, তারা এই আক্রমণের প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেননি। তার অভিযোগের কি সত্যতা নেই?
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অসংখ্য সংগঠন থাকা সত্ত্বেও কোনো একটি সংগঠনও প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি তখনো। অভিযোগ তোলার পর অভিনেতা, পরিচালক, লেখক কলাকুশলীদের কারো কারো ঘুম ভাঙে এবং ফেসবুকে পরদিন এর কিছুটা প্রতিফলন দেখা যায়। বলে দেওয়ার পর এই বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশের শিল্পী-সমাজের মধ্যে সংবেদনশীলতা, পারস্পরিক ভালোবাসা এবং সহানুভূতির যে প্রচণ্ড অভাব, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
একই সময়ে আরেকজন শিল্পী আশনা হাবিব ভাবনাও একই ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। চঞ্চলের অভিযোগের পর অনেকে সরব হলেও ভাবনা কোনো অভিযোগ করেননি। ভাবনার পক্ষে উল্লেখযোগ্য কাউকে দাঁড়াতেও দেখা যায়নি।
চঞ্চল চৌধুরী এবং আশনা হাবিব ভাবনার সঙ্গে কী ঘটেছিল?
মা দিবসে চঞ্চল চৌধুরী তার মায়ের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে। ছবিতে তার মায়ের কপালে সিঁদুর ছিল। আর এতেই তার ওপর ধর্মান্ধ, উগ্র একটি গোষ্ঠী হামলে পড়ে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো অসংখ্য আপত্তিকর মন্তব্য আসতে থাকে, যা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মতো গুরুতর অপরাধ।
একইভাবে আশনা হাবিব ভাবনা মা দিবসে তার মা আর ছোটবোনকে নিয়ে একটি কেক কাটার ভিডিও পোস্ট করেন। তাদের গায়ে ওড়না না থাকার কারণে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি তাদের হিন্দু ট্যাগ দিতেও ছাড়েনি, সেটিও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। এ ছাড়া, তাদেরকে আরও এমনসব আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে, যা নারীর জন্য চরম অবমাননা ও মানহানিকর।
দুটি ঘটনাই দেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে, এই দুটি ঘটনার কোনোটিতেই রাষ্ট্র বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ করেনি, যেমনটি মামুনুল হকের জন্য রাষ্ট্র ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে আইনটির অপপ্রয়োগ করেছিল।
ভাবনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি প্রথমে আমার নজরে আসেনি। এসেছিলো চঞ্চলের ঘটনাটি। তখনো কারও কোনো প্রতিক্রিয়া আমার চোখে পড়েনি। তাই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমি লিখেছিলাম, একটি কাক আক্রমণের শিকার হলে হাজার হাজার কাক ডাকতে শুরু করে। কিন্তু, একজন শিল্পী সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হলেন অথচ সবাই চুপ। গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো পারফর্মারের অভাব নেই দেশে। প্রকৃত শিল্পীর বড়ই অভাব।
চঞ্চল-ভাবনাদের আক্রমণের একই সময়ে আরেকটি ভার্চুয়াল যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে যা একটু দেরিতে নজরে আসলো। টিভি উপস্থাপক মিশু চৌধুরী তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা ও প্রমাণ দিতে গিয়ে তিনি ফেসবুক ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, এসব মৌলবাদী, অসৎ, অসভ্যদের মন্তব্য তিনি নিতে পারছেন না।
তাকে করা আক্রমণের ভাষা প্রকাশযোগ্য নয়। এই জঘন্য, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যগুলো দেখে অনুমান করা যায়, স্বাধীন দেশে নারীদের কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে রাখতে এটি সংঘবদ্ধ কোন একটি গোষ্ঠীর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। যেমনটি হচ্ছে আফগানিস্তানে। সেখানে স্কুলে বোমা হামলা চালানো হয় মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করতে।
কয়েক বছর আগে শিল্পী মোশাররফ করিমও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন একটি মন্তব্য করে। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণের জন্য যদি পোশাক দায়ী হয় তবে পাঁচ বছরের শিশু, বোরখা পরা মেয়েরাও কেন ধর্ষিত হয়? মূলত পোশাক নয়, ধর্ষণের জন্য পুরুষের অসুস্থ মানসিকতাই দায়ী। একটি টেলিভিশনে এই মন্তব্য করে চরম বিপদেই পড়েছিলেন তিনি। দেশজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমত তুলোধুনো করা হয় তাকে। অবশেষে প্রকাশ্য ক্ষমা চেয়ে কোনোরকম বেঁচেছিলেন তিনি। সেবারও শিল্পী সমাজকে তার পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি খুব একটা।
তার আগে অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু অশ্লীল আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন স্বামীর সঙ্গে তার একটি ছবি পোস্ট করে। তার স্বামী নজরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত এই মানুষটির গায়ের রং নিয়ে যেসব আপত্তিকর এবং মানহানিকর মন্তব্যে ফেসবুক ভেসে গিয়েছিল, তা কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। সেসময় তার পাশে তিনি কি কোনো সতীর্থকে পেয়েছিলেন? এভাবে প্রতিদিন শিল্পীদের অনেকেই বিশেষ করে নারী শিল্পীরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এর কোনো প্রতিকার নেই।
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার-অপব্যবহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে বহুদিন থেকে। এই আইনের অপব্যবহারের শিকার হয়েছেন অনেক শিল্পী, লেখক এবং সাংবাদিক। আইনটির কয়েকটি ধারা সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আইনটির বাতিলের দাবি আছে বিভিন্ন মহল থেকে।
আবার নাগরিক সমাজেরই একটা অংশ যারা বিভিন্ন সময়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন, তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও মানহানির মতো ঘটনার প্রতিকারের স্বার্থে সংশোধিত আকারে হলেও আইনটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কেউ কেউ মনে করেন অনলাইন দুনিয়ায় গড়ে ওঠা ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, চক্রের আক্রমণের প্রতিকার পেতে আইনটির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর অপব্যবহারের পথ বন্ধ করে আইনটি সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তামূলক ও মানবিক করা হোক।
এই আইনের ২৮ ধারায় মূলত ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধে আঘাতের অপরাধের জন্য ৫ বছর কারাভোগের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনের এই ধারার সুবিধা সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে নিতে পারবেন। কোনো বিশেষ ধর্মের জন্য বা একক কোনো ধর্মকে সুরক্ষা দিতে এই আইন নয়। তাই যেকোনো ধর্মের অবমাননা বা যেকোনো ধর্মের মানুষের অনুভূতি ও মূল্যবোধে আঘাতই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এই ধারায় সচরাচর যে সব মামলা হতে দেখা যায়, তা মূলত মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য। অন্য ধর্মের মানুষের অনুভূতিতে আঘাতের মামলা খুব একটা চোখে পড়ে না। সাম্প্রতিক সময়ে শাল্লার ঝুমন দাসের মামলাটি বিশ্লেষণ করলে অনুভব করা যায় যে, বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে খুশি করতেই মামুনুল হককে উগ্র-সাম্প্রদায়িক বক্তা বলায় একজন সংখ্যালঘু নাগরিক ঝুমনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে, যার বাদী পুলিশ অর্থাৎ রাষ্ট্র। অথচ মামুনুল হক যে উগ্র-সাম্প্রদায়িক বক্তা, সেটি কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?
প্রশ্ন আসতে পারে- শিল্পীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না কেন? শিল্পীদের একটা বড় অংশ এই অমানবিক আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। নৈতিকতার প্রশ্নেই তাদের অনেকে এ আইনের প্রয়োগ চান না। তাদের ওপর যে পরিমাণ আক্রমণ হয় আর প্রত্যেক আক্রমণের জন্য আইনের আশ্রয় নিলে দেশের কারাগার ভরে উঠবে, নিশ্চিত। কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ও বন্দির সংখ্যা তো সবারই জানা।
এ ক্ষেত্রে শিল্পী-সমাজ অনলাইন-অফলাইনে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু, তারা নীরব কেন? ভয় কীসের? কারও কারও মতে, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে ফলোয়ার, লাইক, কমেন্ট কমে যাবে! আবার ক্ষেত্র বিশেষে সংঘবদ্ধ রিপোর্ট খেয়ে একাউন্ট হারানোর ভয়ও আছে। সরকারের ভুলের প্রতিবাদ করলে রাষ্ট্রীয় দাওয়াত, অনুষ্ঠান বা সরকারি কাজ না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দুই কূল রাখতে গিয়ে সব কূল যাওয়ার অবস্থা এখন আর্ট-কালচারের মানুষদের।
বিগত কয়েক বছরে দেশের একটা প্রজন্ম এভাবে ধর্মান্ধ এবং উগ্র হয়ে উঠল কেন? দেশে সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবই কি এর জন্য দায়ী? একসময় পাড়া-মহল্লার ক্লাবগুলো খেলাধুলার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে কনসার্ট, নাচ-গানের আয়োজন করতো। সেই ক্লাবগুলো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় টেন্ডারবাজি, হাউজি, জুয়াসহ বৈধ-অবৈধ নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এই সুযোগে ইউটিউব মাওলানাদের ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও জিহাদের ডাক দখল করে নেয় তরুণ প্রজন্মের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস এবং মস্তিষ্ক। এর বিপরীতে যে জোরালো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন তা কি আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃস্থানীয়রা অনুভব করতে পারেন? নাকি এই ভাবনাটুকুর জন্য তাদের হাতে সময় নেই। সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে তারা প্রচণ্ড ব্যস্ত?
জসিম আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments