কুম্ভমেলা আর নির্বাচন: ভারত শুধু নিজে নয়, সংকটে ফেলেছে দক্ষিণ এশিয়াকে

করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে ঘিরে বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই অনেক আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সেই সতর্কবার্তা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েও ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশ এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপট পুরোটা সামলাতে পারেনি। তবে ঢেউ আটকানোর জন্যে এইসব দেশের উদ্যোগ ছিল আন্তরিক। জাপান নিজের দেশে আসন্ন অলিম্পিক আয়োজন স্থগিত করতে অযথা দেরি করেনি।
কুম্ভমেলা ও পশ্চিমবঙ্গে বিধান সভা নির্বাচনে বিজেপির একটি র‌্যালি। ছবি: সংগৃহীত

করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে ঘিরে বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই অনেক আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সেই সতর্কবার্তা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েও ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশ এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপট পুরোটা সামলাতে পারেনি। তবে ঢেউ আটকানোর জন্যে এইসব দেশের উদ্যোগ ছিল আন্তরিক। জাপান নিজের দেশে আসন্ন অলিম্পিক আয়োজন স্থগিত করতে অযথা দেরি করেনি।

ভারতীয় উপমহাদেশে আর কোনো দেশ বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা অতটা অবহেলা করেনি, যতটা করেছে ভারত।

আন্তর্জাতিক সব সতর্কবাণী উপেক্ষা করে কুম্ভমেলা করেছে ভারত। লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে জনসভা করেছে, নির্বাচন করেছে। পরিণতিতে এখন ভারতে করোনায় মৃতদের মরদেহ পোড়ানোর, দাফনের জায়গা পর্যন্ত নেই। মরদেহ সৎকারের জন্য পর্যন্ত মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশ, বিহারে গঙ্গা-যমুনার পানিতে করোনায় মৃতদের পচা-গলা মরদেহ।

দ্বিতীয় ঢেউয়ের সতর্কবার্তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই ভারত সরকারের কাছেও অনেক আগেই এসেছিল। সেই ঢেউ মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে কেবলমাত্র ভ্যাকসিন কেনার কিছু টাকা বরাদ্দের বাইরে একটি উদ্যোগও ভারত সরকার নেয়নি। ২০২০ সালে করোনার প্রথম প্রকোপের সময় বিশ্বের প্রায় সব দেশ যখন ব্যস্ত থেকেছে লকডাউনসহ বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে মহামারি মোকাবিলায়, ভারত সরকারই তখন কার্যত প্রত্যক্ষভাবে বিধায়ক কেনাবেচা করে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের সরকার সরিয়ে বিজেপির সরকার তৈরিতে ব্যস্ত থেকেছে।

তারপরেও থালা বাজানো, শাঁখ বাজানো ইত্যাদির মতো চরম অবৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর সঙ্গে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্ত থেকে এই মহামারির প্রকোপে ভারতের পাশাপাশি এর প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিক জীবন ও অর্থনৈতিক জীবনকে এক চরম সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

প্রথম ঢেউয়ের কিছুকাল আগে দিল্লিতে তাবলীগে জামাতকে ঘিরে তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে মহামারি সংকটকালেও নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সব রকম চেষ্টা করেছে ভারতের শাসক দল বিজেপি। তাদের তখন একমাত্র লক্ষ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, তামিলনাড়ু এবং পন্ডিচেরির নির্বাচন।

গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে সতর্ক করছিলেন। সেই সতর্কতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কুম্ভমেলা আর চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন করে ভারত সরকার কি কেবলমাত্র মৃত্যু উপত্যকা বানালেন নিজের দেশটিকেই? প্রতিবেশী বাংলাদেশ, যাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগ ভারতের সবচেয়ে বেশি, সেই বাংলাদেশের লাখো মানুষের জীবন-জীবিকাকে চরম অনিশ্চিত করে দেওয়ার দায়ও নিতে হবে ভারতকে।

তাবলীগে জামাত প্রথম দফায় করোনা ছড়িয়েছিল, বিজেপি নেতাকর্মীরা সরাসরি অভিযুক্ত করেছিল মুসলমানদের। মুসলমানদের তখন বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা ‘করোনা’ বলে ডাকতো। তাহলে এবারের কুম্ভমেলার দায়, যেখান থেকে ভয়াবহ সংক্রমণের কথা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সেটি কেন ভারতের শাসক দল বিজেপি নেবে না?

কুম্ভমেলাকে যে পরিমাণ অনুদান দিয়েছে ভারত সরকার, তার সামান্য কিছুও যদি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্যে বরাদ্দ করা হতো, তাহলেও হয়তো এতো বড় বিপর্যয়ের মুখে দেশটিকে পড়তে হতো না। কুম্ভমেলায় অংশ নেওয়া প্রতি ১০ জনের নয় জনই করোনায় আক্রান্ত। অথচ, দ্বিতীয় ঢেউ আসছে, বিজ্ঞানীরা বারবার বলেছেন। ভারত সরকার এতো বিপুল পরিমাণ মানুষের সমাগম আটকানোর ন্যুনতম ব্যবস্থাও করেনি, উল্টো মেলাকে উৎসাহিত করতে চার হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মেডিকেল জার্নাল ‘দ্য লানসেট’ কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় মোদি প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা ঘিরে যে ধরণের সমালোচনা করেছে, তা থেকেই বোঝা যায় ইচ্ছাকৃত ত্রুটির ভেতর দিয়ে মোদি প্রশাসন কেবল তার দেশের নাগরিকদের জীবন, জীবিকা, অর্থনীতিকেই চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়নি, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলকেই চরম সঙ্কটের ভেতরে ফেলে দিয়েছে। এই পত্রিকায় যেভাবে করোনা মোকাবিলায় মোদি সরকারের সার্বিক ব্যর্থতার সমালোচনা করা হয়েছে, সামাজিক ক্ষেত্রে ৪৭’ এর পরে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে এভাবে আর সমালোচিত হয়নি ভারত।

দ্য লানসেটে প্রকাশিত খবরের প্রথমেই বলা হয়েছে; কোভিডের এই ভয়াবহ আক্রমণের আবর্তে সংক্রমণ মোকাবিলাতে আদৌ মন নেই মোদি প্রশাসনের। তারা কেবল ব্যস্ত টুইটারে তাদের সমালোচনাগুলো মুছতেই।

এতে আরও বলা হয়েছে, ভারতবাসীর প্রতি মোদি সরকারের এই আচরণ ক্ষমার অযোগ্য।

খুব স্পষ্ট ভাবে এই পত্রিকা লিখেছে, মোদি প্রশাসন নিজেদের এই ভুল স্বীকার করে সেই ভুল সংশোধনে সচেষ্ট না হলে কিছু করার থাকবে না।

বিশ্বের উন্নত দেশ এবং গরীব দেশগুলোও বাণিজ্যের কথা না ভেবে দেশের নাগরিকদের করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করেছে। ভারত সরকারের কাছে দেশের মানুষের স্বার্থ এতোটুকুও গুরুত্ব পায়নি। ভারত সরকার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের কথাই ভাবেনি।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে যাবতীয় সতর্কতা সত্ত্বেও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আদৌ যথার্থ ভূমিকা পালন করেনি ভারত সরকার। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের চরম গাফিলতির কারণে যারা প্রথম ডোজ পেয়েছেন, তারা এখন আর দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছেন না। ফলে গোটা ভারত জুড়েই এই ভ্যাকসিন ঘিরে একটা চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ভ্যাকসিনকে ঘিরে তৈরি অনিশ্চয়তাকে রাজনৈতিক মাইলেজ হিসেবে নিয়ে ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরেই সকলের জন্যে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন মমতা।

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে মমতা বলেছিলেন, ২ মে তিনি জেতার পরেই ৫ মে থেকে সার্বজনীন ভ্যাকসিনেশন শুরু করে দেবেন। এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে কোনো অবস্থাতেই যেন প্রভাব ফেলতে না পারে, তাই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে নিজের গা বাঁচিয়ে রাখলেন মমতা।

নির্বাচন সামনে থাকায় গত বছর লকডাউনের ফলে মানুষের রোজগারে চরম বিপর্যয় নেমে এলেও রেশনে চাল, গম, ছোলা ইত্যাদি দেওয়ার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে উৎসাহ ছিল এ বছর তা নেই। খাতা-কলমে লকডাউন না হলেও লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় গরিব মানুষের ওপর যে সঙ্কট নেমে এসেছে তা নিয়ে মোদি বা মমতা, কারোই কোনো মাথাব্যথা নেই।

বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে যে দীর্ঘ আট দফার নির্বাচন হলো, তাতে কেবল পশ্চিমবঙ্গবাসীকেই করোনার চরম সঙ্কটে ফেলা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান এবং মানুষের যাতায়াত অনেক খুব বেশি। ফলে এই সঙ্কট বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলেছে।

করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ আসছে, এই সতর্কতা যখন প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় আগে আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ভারত সরকারের কাছে এসেছিল, তখন কেন বিধানসভার নির্বাচন ভারত সরকার এগিয়ে দেয়নি? আজ যদি বিহার বিধানসভার নির্বাচনের সঙ্গে গত বছরের ডিসেম্বরেই আসাম ও পশ্চিমবঙ্গেও নির্বাচন হতো, তাহলে এখানে করোনার এই ভয়াবহতা আসতো না। পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশও এতোখানি সঙ্কটাপন্ন হতো না। নির্বাচন চলাকালীন দীর্ঘসূত্রিতা ঘিরে চেন্নাই হাইকোর্টের যে পর্যবেক্ষণ তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হয় যে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই ভয়াবহতা ঘিরে কুম্ভমেলার মতোই এই দীর্ঘ নির্বাচনও কম দায়ী নয়। ভোটের পঞ্চম পর্বের পরই করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে বামপন্থীরা বড় সভা করেননি। ভার্চুয়াল প্রচারই বেশি করেছেন। বিজেপি আর তৃণমূল অবশ্য বড় সভা থেকে সরে আসেনি।

চলতি বছরের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মেয়াদ শেষ। যদি বিধানসভা নির্বাচন করোনার কারণে স্থগিত করে দেওয়া হতো, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হতো। শাসন ক্ষমতা থাকতো রাজ্যপালের হাতে। রাজ্যপালের কলমে বিজেপির নিয়ন্ত্রণ কায়েম হতো পশ্চিমবঙ্গে। এটা মমতা কখনোই মেনে নিতেন না। বামপন্থীরাও মানতেন না।

ভারতের নির্বাচন কমিশন যদি প্রকৃতই ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে কাজ করতো, তাহলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আসন্নতা বিবেচনা করে বিহারের নির্বাচনের সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের নির্বাচন শেষ করে ফেলত। এতে করে বড় সঙ্কটের ভেতরে গোটা মানবজাতিকে পড়তে হতো না। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে নির্বাচন করতে হলে রাজ্য সরকারের সম্মতি দরকার হয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা বিবেচনা করে বড় সঙ্কট এড়ানোর স্বার্থে এতে মমতা খুব একটা আপত্তি করতেন বলেও মনে হয় না।

 

গৌতম রায়: ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
economic challenges for interim government

The steep economic challenges that the interim government faces

It is crucial for the interim government to focus on setting a strong foundation for future changes.

15h ago