প্রবাস

ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অন্য রকম ঈদ

লকডাউন আর নিষেধাজ্ঞায় একেবারে অন্য রকম ঈদ উদযাপন করল ওমানের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সঙ্গে ওমানেও বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে। সব দেশেই ঈদগাহ ও মসজিদে নামাজ আদায় এবং চলাচলসহ বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হলেও শুধু ব্যতিক্রম ওমান। করোনার নতুন স্ট্রেইনের সংক্রমণ রোধে সপ্তাহখানেক আগেই কড়া নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটিতে। ঈদের নামাজ, পারিবারিক সমাবে ও পযর্টন কেন্দ্র বন্ধসহ নানা বিধিনিষেধ এবং রাত্রিকালীন লকডাউন বদলে দিয়েছে ঈদের আমেজ।
Probas_14May21.jpg
ওমানে ঈদগাহ বা মসজিদে নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাসার আঙিনায় ঈদের নামাজ পড়ছেন প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা। ছবি: স্টার

লকডাউন আর নিষেধাজ্ঞায় একেবারে অন্য রকম ঈদ উদযাপন করল ওমানের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সঙ্গে ওমানেও বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে। সব দেশেই ঈদগাহ ও মসজিদে নামাজ আদায় এবং চলাচলসহ বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হলেও শুধু ব্যতিক্রম ওমান। করোনার নতুন স্ট্রেইনের সংক্রমণ রোধে সপ্তাহখানেক আগেই কড়া নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটিতে। ঈদের নামাজ, পারিবারিক সমাবে ও পযর্টন কেন্দ্র বন্ধসহ নানা বিধিনিষেধ এবং রাত্রিকালীন লকডাউন বদলে দিয়েছে ঈদের আমেজ।

বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রকৌশলী মোস্তফা কামাল বলেন, ‘করোনা মহামারির এই মুহূর্তে বিশ্ব চ্যালেঞ্জিং ও কঠিন সময় পার করছে। প্রচুর রীতিনীতি ও ঐতিহ্যকে প্রভাবিত করেছে যা সাধারণত ঈদে অনুসরণ করা হয়। নিজের, পরিবার এবং সমাজের সুরক্ষায় সমাবেশ এখন আর নিরাপদ নয়। কাজেই এ দেশের নাগরিকদের মতো প্রবাসী কমিউনিটিও সুপ্রিম কমিটির নিষেধাজ্ঞা মেনেই ঈদ উদযাপন করছে।’

একই মত দিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির সিরাজুল হক বলেন, ‘স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে নিষেধাজ্ঞা আর লকডাউনে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজন ছাড়াই আমাদের ঈদ করতে হচ্ছে। কমিউনিটি পুনর্মিলনও বন্ধ রাখা হয়েছে। সবার সুরক্ষার স্বার্থেই প্রবাসীরা তা মেনে চলবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।’

রাজধানী মাস্কাটে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি থাকেন হামিরিয়া এলাকায়। প্রতি বছর ঈদের সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এলাকার প্রধান সড়কজুড়ে সাধারণ প্রবাসীদের মিলন মেলা বসে। এবার পুরো এলাকায় পিন-পতন নিরবতা। রাজধানীর বাকি এলাকাসহ পুরো ওমানের ঈদের চিত্রটা ছিল এমনই। যান চলাচলও সীমিত। সমাবেশ, কোলাহাল নেই কোথাও। জনসমাবেশ রোধে রাজধানীসহ সব প্রদেশে কড়া নজরদারি করছে রয়েল ওমান পুলিশ।

‘ওমানে এখন বাংলাদেশিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রবাসী। উৎসব আর সমাবেশে আমাদের যেহেতু জুড়ি নেই তাই বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পুলিশের কড়াকড়িটা বেশি’— বলেন প্রবাসী সাংবাদিক মীর মাহফুজ আনাম।

দেশের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরাও উৎসব আমেজে ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। নামাজ আদায়, কুশল বিনিময়, পারিবারিক সমাবেশ, আত্বীয় স্বজন, কমিউনিটির ঘনিষ্টজনদের বাড়ি ও দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যাওয়ার মতো ঐতিহ্য ও রীতিতে ঈদ উদযাপন সেখানেও প্রচলিত। এ বছরও ঐতিহ্যবাহী উদযাপনের অনুপস্থিতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই মনকষ্টে আছেন। তারপরও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে আনন্দ উপভোগের উপায় বের করে নিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ঘরে বসেই ঈদের নামাজ আদায়, সীমিত ব্যবস্থায় রীতি-রেওয়াজ আর আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত কম বেশি সবাই।

ব্যবসায়ী ও কমিউনিটি সংগঠক আজিমুল হক বাবুল বলেন, গতবারের মতো এবারও একেবারে ভিন্ন আমেজে ঈদ করছি। এ ছাড়া, উপায়ও নেই। করোনা আমাদের অনেক কিছু পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন অভিজ্ঞতাও দিয়েছে। ঘরে বসে ঈদ উদযাপনে বৈচিত্র্যের স্বাদও পাচ্ছি।’

বিষাদ দূর করার অন্যতম সেরা উপায় হলো বাড়িকে উৎসবের চেহারা দেওয়া উল্লেখ করে প্রবাসী সিআইপি ও কমিউনিটি সংগঠক মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা উৎসবের আমেজে ঘর সাজিয়েছি। বাসার আঙিনায় পরিবারের সবাই একসঙ্গে নামাজ পড়েছি। ঈদের ঐতিহ্যের খাবার আয়োজনের সঙ্গে বাচ্চাদের নিয়ে সুইমিং পুলে ওয়াটার গেমসহ কিছু আনন্দময় কাজে যুক্ত থাকছি। খুব অল্প সংখ্যক কমিউনিটি স্বজন ও বন্ধুবান্ধবও এসেছিলেন। কষ্টটা শুধু আগের মতো পারিবারিক বড় সমাবেশের অনুপস্থিতি।’

Probas4_14May21.jpg
ওমানে নিষেধাজ্ঞার কারণে ঘরবন্দি হয়ে প্রবাসী পরিবারের ঈদ আনন্দ উৎসব। ছবি: স্টার

প্রবাসী ব্যবসায়ী এস এম জসীম উদ্দিন বলেন, ‘ঈদের আনন্দের অনেকটাই ঘরের বাইরে, অথচ করোনা আমাদের ঘর বন্দি করেছে। প্রয়োজনটা যখন জীবন বাঁচানোর, আমি মনে করি, এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কী হতে পারে! আমরা সেই আনন্দেই আছি। জুমের মাধ্যমের বন্ধু-বান্ধব এবং কমিউনিটির ঘনিষ্টজনদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছি। বাইরে বেড়ানোর হতাশা কাটাতে বাচ্চাদের গান-বাজনাসহ নানা বিনোদনের সুযোগ দিয়ে আনন্দ উপভোগ করছি।’

শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে খাবার নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে বেশি আনন্দ পেতাম। এ ছাড়া, কোনো গার্ডেন বা বিচে প্রবাসী সংস্থা-সংগঠনগুলোর ঈদ পুনর্মিলনীতে আমরা খুঁজে পেতাম দেশের আমেজ। গতবারের মতো এবারও তা খুব মিস করছি।’

দূরের শহর কাসাব প্রবাসী জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রেটার মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘দিনে প্রচণ্ড গরমে বের হওয়া যায় না। সন্ধ্যার পর লকডাউনের জন্য বের হওয়া নিষেধ। পার্ক, বিচ, বিনোদন কেন্দ্র সবই বন্ধ। বাচ্চাদের নিয়ে ঘরেই ঈদের আনন্দ করতে হচ্ছে।’

সামাজিক যোগাযোগ, সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যমে ভার্চুয়াল আড্ডায় যুক্ত হয়ে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করছেন অনেক প্রবাসী। এ ছাড়া, বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে চ্যাট করে সময় পার করেছেন কেউ কেউ। রাজধানীর মোটর পাটর্স ব্যবসায়ী নাসির মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের চলাচল সীমাবদ্ধ। তাই  বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়েই ঈদ উদযাপন করতে হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে সামাজিক মিডিয়ায় ভার্চুয়াল উদযাপনে যোগ দিয়েছি।’

Probas3_14May21.jpg
ওমানে সামাজিক যোগাযোগ, পারিবারিক সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় স্বজন ও অতিথিদের ছাড়াই ঈদের খাবার উপভোগ করেন প্রবাসীরা। ছবি: স্টার

অতিথি আসা সীমিত থাকলেও রেওয়াজ অনুযায়ী ঈদের রান্নাবান্নায় কমতি রাখেননি প্রবাসী পরিবারের গৃহিনীরা। মাস্কাটের বাসিন্দা তাসলিমা আশরাফ মিলি বলেন, ‘বাইরে নামাজ না থাকায় সাত সকালে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখার তাড়া ছিল না বটে, কিন্তু আমাদের ঈদ ঐতিহ্যের সব খাবারের আয়োজন করেছি। প্রবাসেও আমরা একান্নবর্তী পরিবার। সবাই একসঙ্গে ভোজন, হই-হুলোড় করে ঈদ আনন্দে মেতেছি।’

ওমানে অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয় কম। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের অনেকেই পরিবার নিয়ে থাকেন। যাদের আয় কম তাদের বেশিরভাগই পরিবার ছাড়া প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। দল বেঁধে নামাজ পড়া, রান্না করা আর বেড়ানোর মধ্যে তারা ঈদ আনন্দে মাতেন। করোনার নিষেধাজ্ঞায় এবার তাদের সব আনন্দে ম্লান হয়ে গেছে।

সালালহ প্রবাসী আলম শরীফ বলেন, ‘আগে আমরা সকলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম। কমিউনিটি ছাড়াও ওমানি এবং বিভিন্ন দেশের প্রবাসী ভাইদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হতো। কোলাকুলি করতাম। এরপর দল বেঁধে দিনভর ঘোরাঘুরি আড্ডা। এবার বাসার ছাদে আর বাড়ির সিঁড়িতে আড্ডা মেরে কেটেছে। কারণ দুজনের বেশি বাইরে চলাচল নিষেধ।’

Probas2_14May21.jpg
ওমানে সামাজিক যোগাযোগ, সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ঘরের ভেতরে, সিঁড়িতে ঈদ আড্ডায় পরিবার ছাড়া প্রবাসীরা। ছবি: স্টার

সোহারের তরুণ বাংলাদেশি উদ্যোক্তা জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশে প্রিয়জনদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে আর ঘুমিয়ে কেটেছে আমাদের এবারের ঈদ।’

ঈদকে উপলক্ষ করেই অধিকাংশ প্রবাসী দেশে যান। এবারও তেমন প্রস্তুতি নিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু ১ মে থেকে ওমান প্রবাসীদের দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ফলে শত শত প্রবাসীর আর দেশে ফেরা সম্ভব হয়নি।

তেমনই একজন সিব বাজারের রফিকুল ইসলাম মিয়া। তিনি বলেন, ‘অনেক বছর পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারিনি। ভেবেছিলাম এবার দেশে যাব। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হলো। প্রবাসী বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করব— লকডাউনের কারণে তা-ও পারিনি। করোনা সব আনন্দ, উচ্ছ্বাস শেষ করে দিলো।’

প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানান, ওমান শুরুতে থেকেই বৈশ্বিক করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কড়াকড়ি অবস্থা অব্যহত রেখেছে। এতে সুফলও এসেছে। প্রবাসীরাও বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। গত বছরের মার্চ থেকে নিষেধাজ্ঞা, লকডাউন শুরু হয়েছে। বিরতি দিয়ে, সময় পরিবর্তন করে এখনো চলছে।

গত বছর রমজানে শপিং মল, দোকানপাট বন্ধ ছিল। এবারও সপ্তাহ খানেক আগে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ২৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। তারও আগে রাত্রিকালীন লকডাউনে সন্ধ্যা রাতেই বন্ধ হয়ে যেত সব কিছু। এতে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি প্রভাবিত হয়। অনেকেই ঈদের কেনাকাটা করতে না পারেননি।

‘গত বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাই এই বছর আমি আগেই ঈদের শপিং শেষ করেছিলাম। তা ছাড়া, অনলাইন শপিংয়ের সুযোগ ও বৈচিত্র্য প্রবাসীদের অনেকেরই আগাম কেনাকাটায় সাহায্য করে’, বলেন রাজধানীর নির্মাণ সংস্থার কর্ণধার মোহাম্মদ রিয়াদ।

পুরো পৃথিবীতে করোনা এই চরম সময় একদিন কাটিয়ে উঠবে, ঐহিত্য আর রেওয়াজে আবারও ধর্মীয় উৎসবগুলোতে উদযাপিত হবে এমন প্রত্যাশা রেখেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

এজাজ মাহমুদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Banks mostly gave loans to their owners rather than creditworthy borrowers

Bangladesh’s banking sector was not well-managed in recent years. Banks mostly gave loans to their owners, rather than to creditworthy entities. Consequently, several banks are now in difficulty.

11h ago