১৪ মে ১৯৭১: বাড়িয়া ও নড়িয়ায় গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৪ মে ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন হাঙ্গেরির বুদপেস্টে বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসের অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা পড়ে শোনানো হয়।
১৪ মে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী জাতিসংঘের এক কমিটিতে বলেন, ‘পাকিস্তান নিয়ে কোনো আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।" লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীকে এদিন পূর্ব পাকিস্তানের সহকারী সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এদিন আসামের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করেন। বরিশালের বাকাই গ্রামে এদিন গ্রামবাসীর রামদার আঘাতে ৪ পাকিস্তানি হানাদার নিহত হয়েছিল। এদিন গাজীপুরের জয়দেবপুরের বাড়িয়া গ্রামে হানাদারদের নির্মম গণহত্যায় শহীদ হন দুই শতাধিক মানুষ। এদিন সিলেটের মৌলভীবাজারের নড়িয়া গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালিয়ে ২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল হানাদারেরা। দেশের অজস্র জায়গায় পাকিস্তানা হানাদারদের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী।
বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিদের বিবৃতি ও বক্তব্য
১৪ মে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসের এক অধিবেশনে ভারতের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য ও বার্তা পড়ে শোনানো হয়। ইন্দিরা গান্ধীর লিখিত এই বার্তা পাঠ করেন ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য অমৃত নাহার। এই লিখিত বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, "ভারত এখন যে পরিস্থিতির মধ্যে আছে তাতে পূর্ববঙ্গের প্রতি কী করে উদাসীন থাকবে? ত্রিশ লাখের বেশি শরণার্থী এখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্ববঙ্গে চরম গণহত্যা নির্যাতন চালানো হয়েছে। নাগরিকদের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই, নারীদের ধর্ষণ সেখানে অহরহ হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিবেক চুপ কেন? এই মুহূর্তে সবার উচিৎ পূর্ববঙ্গের মানুষের গণদাবি মেনে নেওয়া। বিশ্ব বিবেক ও বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় ও মুক্তিকামী মানুষের উচিত এগিয়ে আসা। তারা চাইছে তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই তাদের শাসক নিযুক্ত হবে। যেহেতু সেখানে সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগ হয়েছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অবশ্যই সরকার গঠনের অধিকারও আছে।"
অন্যদিকে এই দিন ভারতীয় প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য কৃষ্ণ মেনন বলেন, "পূর্ববঙ্গে কোনো সাধারণ ঘটনা ঘটছে না। সেখানে প্রতিনিয়ত জনগণের উপর দমন পীড়ন চালানো হচ্ছে। সামরিক শাসকেরা ভাবছে সাধারণ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে গণদাবি ধ্বংস করা যাবে!"
ভারতের লোকসভা সদস্য সমর গুহ সীমান্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে কলকাতায় ফিরে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "শরণার্থী শিবির এখন শরণার্থীতে ভর্তি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে শরণার্থী সমস্যার ফলাফল ভারতের উপরে উঠে আসবে। বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আর তার পরিণাম ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত ভারতে।"
ভারতের আদি কংগ্রেসের মুম্বাই শাখায় এক বৈঠকে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। লিখিত এই প্রস্তাবে বলা হয়, ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে তবে বিশ্বের বহু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য এগিয়ে আসবে।
১৪ মে কলকাতায় চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের সংগঠন বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন কলকাতার লাইট হাউজ সিনেমা হলে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে। সেখানে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রদর্শনী থেকে লব্ধ অর্থ মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জরুরি কাজে ব্যয় করা হবে। পরে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে টিকেট বিক্রিলব্ধ অর্থ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী তরুণ কান্তি ঘোষের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
১৪ মে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দুই দিন আসামের কাছাড় জেলায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের পর আসামের শিলচরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধিদলের নেতা চার্লস মেস বলেন, "বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলায় ভারতকে সম্ভাব্য সব সহযোগিতা করা হবে।"
ঢাকায় ১৪ মে
১৪ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের সহকারী সামরিক শাসক নিযুক্ত করা হয়।
১৪ মে পিডিপির সহ-সভাপতি মৌলভী ফরিদ আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ভারত ও অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের শেষ পরিণতি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী খালিদ-বিন-ওয়ালিদের সত্যিকার বংশধর। সেনাবাহিনী শুধু দেশকে নয়, পূর্ব পাকিস্তানিদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে।"
বাড়িয়া গণহত্যা
১৪ মে পাকিস্তানি হানাদারেরা রাজাকারদের সহযোগিতায় গাজীপুরের জয়দেবপুরের বাড়িয়া গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়। বাড়িয়া গ্রাম ছিল প্রায় হিন্দু জনবসতিপূর্ণ গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভাওয়াল এস্টেটে সেনানিবাস স্থাপন করেছিল। ভাওয়াল এস্টেটের সেনানিবাস থেকে বাড়িয়ার দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার।
১৪ মে দুপুর ১ টার দিকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় হানাদার বাহিনী সেনানিবাস থেকে কয়েকটি জিপ ও মিলিটারি ট্রাক নিয়ে বাড়িয়া গ্রামের চারপাশ ঘিরে ফেলে। এরপর গ্রামে প্রবেশের পরে সেনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করা শুরু করে। গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকে ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং অন্যরা গুরুতর আহত হন। হানাদার ও রাজাকারেরা বাড়িঘর লুট করে, গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের কয়েকজন পুরুষ প্রাণের ভয়ে বেলাইয়ের বিল পেরিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে গেলে হানাদারদের চোখে পড়ে গেলে তাদের বিল থেকে তুলে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। দুপুর একটা থেকে শুরু হওয়া এই গণহত্যা চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সন্ধ্যার সময় প্রবল বৃষ্টি শুরু হওয়ায় পাকিস্তানি হানাদারেরা গ্রাম ছেড়ে সেনানিবাসে ফিরে যায়। হানাদার ও রাজাকারদের এই নির্মম গণহত্যায় বাড়িয়া ও কামারিয়ার ২০০ গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিলেন।
নড়িয়া গণহত্যা
১৪ মে পাকিস্তানি হানাদারেরা রাজাকারদের সহযোগিতায় সিলেটের মৌলভীবাজারের কাগবালা ইউনিয়নের নড়িয়া গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়। রাজাকারদের সহযোগিতায় শেরপুর ক্যাম্প থেকে সাধুহাটি গ্রামের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে ১২ জন হানাদার সৈন্য নড়িয়ায় এসে পৌঁছায়। তাদেরকে সহায়তা করে নিয়ে এসেছিল মৌলভীবাজার শান্তি কমিটির সভাপতি এ এন এম ইউসুফ। এর মধ্যে পাকিস্তানি হানাদারদের আসতে দেখে ইতিমধ্যে কিছু গ্রামবাসী নিকটবর্তী ফরছা বিলে আশ্রয় নেয়, অনেকে প্রাণের ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। যখন হানাদারেরা গ্রামে এসে পৌঁছায় তখন গ্রামবাসীকে পালাতে দেখে গুলি করার হুমকি দেয়। এসময় একশোরও বেশি নারী, পুরুষ, বৃদ্ধকে আটক করে হানাদার ও রাজাকারেরা। এরপর তাদের কামিনী কুমার দেবের বাড়িতে আনা হয়। মহিলা এবং শিশুদের, পুরুষদের কাছ থেকে আলাদা করে কারারুদ্ধ অবস্থায় একটি ঘরে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।
এরপর কামিনী কুমার দেবসহ পুরুষদের একটি লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করে হানাদারেরা। পুরুষদের হত্যার করার পর হানাদার সেনারা নারীদের ধর্ষণ করে। এসময় রাজাকার ও আলবদরের সদস্যরা ১৯টি বাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। এই গণহত্যার পর, নড়িয়া একটি জনমানবহীন গ্রামে পরিণত হয়েছিল। যাওয়ার সময় রাজাকারেরা জীবিত গ্রামবাসীকে হুমকি দিয়েছিল কেউ লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। দুদিন পর কামিনী কুমার দেব এবং স্ত্রীর গলিত লাশ তাদের পোড়া বাড়ি থেকে তুলে আনা হয়েছিল।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ ও অন্যান্য ঘটনা
১৪ মে বরিশালের বাকাই গ্রামে পাকিস্তানি হানাদারেরা গ্রামে ঢোকার সময় স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষ হয়। এসময় গ্রামবাসীদের বল্লম ও রামদার আঘাতে চার পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
১৪ মে হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে। এই অভিযানে ৫৪ জন পুলিশ আত্মসমর্পণ করেছিল। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা হেমায়েতপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ কর্মী লক্ষ্মীকান্ত বলের অনুরোধে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করে।
১৪ মে কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে পরিকোটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ওপর নদীর পাড় থেকে পাকিস্তানি হানাদারেরা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে পিছু হটে।
১৪ মে দুপুরে পাকিস্তানি হানাদারেরা চৌদ্দগ্রামও আক্রমণ করে। ৪-৫ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা চৌদ্দগ্রামের পাশে ভারত সীমান্তের রাঙ্গামুড়া এলাকায় আশ্রয় নেয়।
কক্সবাজারে ন্যাপের আহ্বায়ক মাহমুদুল হক চৌধুরী এক বক্তব্যে বলেন, "যে দল পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাস করে না, পাকিস্তান অটুট থাকুক তা চায় না, সে দলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কক্সবাজারে আমি আহ্বায়ক হিসেবে এই দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করছি।"
১৪ মে সাবেক এমএনএ আবদুর রব এবং খান চৌধুরী ফজলে রবের নেতৃত্বে বরিশাল জেলায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র - সপ্তম, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২, ৩, ৫ ও ৭ নম্বর সেক্টর।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৫ মে, ১৯৭১
দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ মে ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ মে ১৯৭১
আরও পড়ুন-
১৩ মে ১৯৭১: ডেমরা ও সাতানিখিলে নির্মম গণহত্যা
১২ মে ১৯৭১: সাতবাড়িয়া গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক তৎপরতাময় দিন
৩ মে ১৯৭১: টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন- ঢাকা এখন মৃত্যুপুরী
১ মে ১৯৭১: ‘বাংলাদেশ এখন একটি চিরন্তন সত্য ও বাস্তবতা’ ভারতীয় শিল্পমন্ত্রী
২৭ এপ্রিল ১৯৭১: কালীগঞ্জে গণহত্যা, ইপিআরের নাম পাল্টে ইপিসিএফ
Comments