প্রবাসে

মৃত্যুপুরী ব্রাজিলে আতঙ্ক আর সংকটে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

গত শনিবারে ছুটির দিনে ক্রেতাশূন্য ব্রাজিলের বাণিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোর শপিং কানিনদে মার্কেট। বন্ধ হয়ে গেছে অনেকে বাংলাদেশি দোকান। ছবি: স্টার

করোনা মহামারিতে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল এখন মৃত্যুপুরী। কোনোভাবেই থামছে না প্রাদুর্ভাব, কমছে না মৃত্যুর হার। প্রতিদিন রেকর্ড প্রাণহানির মাঝে প্রতিনিয়ত মৃত্যু আতঙ্কের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে দেশটির প্রবাসী বাংলাদেশিদের। সুখবর হলো এ পর্যন্ত প্রাণহানি উল্লেখযোগ্য নয়। তবে ব্যবসা ও কর্মহীন হয়ে জীবনযাপনের কঠিন সংকটের মুখোমুখি কমবেশি সবাই, দেউলিয়া হয়ে ব্রাজিল ছাড়ছেন অনেকে।

মৃত্যুপুরীতে বাংলাদেশিরা কেমন আছেন সেই খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায় এসব তথ্য। আরও জানা যায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে বড় বিপদে পড়েছিলেন বাংলাদেশি কূটনীতিকরা। বাংলাদেশ দূতাবাসের ২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী একসঙ্গে করোনা আক্রান্ত হন, যার মধ্যে শীর্ষ দুই কর্মকর্তা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন।

প্রবাসী সংগঠকরা জানান, ব্রাজিলে এক সময় প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি ছিলেন। নানা সময়ে তাদের বেশিরভাগই আমেরিকা পাড়ি দেন। করোনার আগে ৫/৬ হাজার মতো প্রবাসী বাংলাদেশি ছিলেন। মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে আর আয়ের পথ খুঁজতে এরই মধ্যে আরও অনেকে ব্রাজিল ছেড়েছেন। দেশটিতে ৮০’ দশক থেকে বাংলাদেশিদের যাত্রা শুরু হলেও ২০১২ সালের পরেই মূল স্রোত শুরু হয়।

করোনাকালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশিদের অনেকেই আক্রান্ত হলেও তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে এ পর্যন্ত ৬ জন মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস। বাণিজ্যিক রাজধানী ও বৃহত্তম শহর সাও পাওলোতে এ পর্যন্ত করোনায় ১ লাখ মৃত্যুর সংখ্যায় বাংলাদেশি ৩ জন।

বাংলাদেশি কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ী এএইচএম খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘ব্রাজিলে কে করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, কে হচ্ছে না সেটাই বোঝা দায়। যে যার মতো লড়ছে, জীবন যাচ্ছে কিংবা সুস্থ হয়ে ফিরছে। অবস্থা এমনই যে কেউ কারো খোঁজ নেওয়ার বা সহায়তা করার সুযোগ নেই। আর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তো কেউ আক্রান্ত হলে তা জানাতেই চান না। এ পর্যন্ত যে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি হয়নি সেটাই আমাদের সৌভাগ্য।’

রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্সসহ একসঙ্গে ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা করোনা আক্রান্ত হন। ৭ জন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসায় ছিলেন, তার মধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতিতে চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স সামিয়া ইসরাত রনি এবং ডিফেন্স অ্যাটাসি কমোডর সৈয়দ মিজবাহ উদ্দিন আহমেদ ১১ দিন হাসপাতালের আইসিইউতে শংকটাপন্ন অবস্থায় ছিলেন। কাউন্সেলর আবদুল্লাহ আল মামুনও হাসপাতালে চিকিৎসায় ছিলেন।

‘সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও দূতাবাসের সবাই একসঙ্গে করোনা আক্রান্ত হবেন এমনটা ছিল অকল্পনীয়। শেষ পর্যন্ত বড় বিপদ থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। এখন সবাই সুস্থ আছেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই করোনামুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে দূতাবাসে সবাই যোগ দিয়েছেন। কনস্যুলেট সেবাসহ দূতাবাসের সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বশরীরে উপস্থিতি আপাতত বন্ধ রেখে ডাকযোগে প্রবাসীদের কন্সুলার পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে,’ বলেন কাউন্সেলর আবদুল্লাহ আল মামুন।

তিনি জানান, করোনা আক্রান্তের কারণে ২০/২৫ দিনের মতো কর্মকর্তাশূন্য হলেও দূতাবাস বন্ধ করা হয়নি, সুস্থ তিন কর্মী দিয়েই দূতাবাসের কার্যক্রম চালু রাখা হয় । এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম একজন ব্রাজিলিয়ান গাড়িচালক করোনা আক্রান্ত হন। ডিসেম্বরে বিদায়ী রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান এবং তার স্ত্রী আক্রান্ত হন। তারা বাসাতেই চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

দক্ষিণ আমেরিকায় বাংলাদেশের একমাত্র দূতাবাস ব্রাসিলিয়ার অধীনে লাতিন দেশ আর্জেন্টিনা, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে, চিলিও রয়েছে। রাষ্ট্রদূতের বদলিজনিত শূন্যতায় জানুয়ারি থেকে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্বে আছেন দূতালয় প্রধান।

ব্রাজিলে বাংলাদেশিদের প্রধান পেশা কাপড়ের ব্যবসা। এরপরই চাকরিজীবী, বিশেষ করে হালাল মুরগির খামারের কর্মী। এছাড়া কিছু বাংলাদেশি গ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছেন। বাণিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোতেই সবচেয়ে বেশি প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশির বাস।

প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানান, করোনাকালে চরম উশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে দেশটি পরিস্থিতি। করোনা প্রতিরোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই, উপরন্ত এ নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধ তুঙ্গে। রাজ্য সরকার লকডাউন দিলে কেন্দ্রীয় সরকার তা তুলে দিচ্ছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। কমেছে আয় রোজগার, বেড়েছে বেকার। অর্থনেতিক মন্দায় জনগণ দিশেহারা। যার প্রভাবে বাংলাদেশিরাও আছেন মহা সংকটে। 

রাজধানীর বাংলাদেশি কর্মী সিলেটের জয়নুল হক বলেন, ‘বেতন নিয়মিত পাচ্ছি না। কাজও কমেছে। অন্যদিকে ঘড় ভাড়া, বিদ্যুত-পানির বিল নিয়মিত দিতে হচ্ছে। কোনো ছাড় নেই বরং করোনাকালে কয়েক দফা দাম বাড়ানো হয়েছে। নিত্যপণ্যে দাম আকাশচুম্বী। দেশে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা নিজেদেরই চলতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

বাণিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোতে বাংলাদেশিদের ৯০ ভাগই কাপড়ের ব্যবসায় যুক্ত। এর মধ্যে কেউ পাইকারি, কেউ খুচরা ব্যবসায়ী। তার বাইরে বাংলাদেশি মালিকানার বেশ কয়েকটি গামের্ন্টস কারাখানাও রয়েছে, যারা সারা ব্রাজিলে কাপড় সরবরাহ করে স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে। করোনাকালে লোকসান টানতে টানতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেকে দেউলিয়ার খাতায় নাম লিখেছেন।

‘করোনায় জনগণের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। ক্রেতার অভাবের সঙ্গে বেড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয়। পোষাতে না পারায় দিন দিন বাড়ছে দেউলিয়ার সংখ্যা। সাও পাওলোতে ছোট বড় ৫০০০ হাজার কাপড়ের দোকানের মধ্যে এখন বড় জোড় দুই হাজার টিকে আছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আমার নিজের গার্মেন্টস কারখানাটি ৮ মাস বন্ধে ৩৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে,’ বলেন সাও পাওলোর গার্মেন্টস মালিক ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব এএইচএম খায়রুল ইসলাম।

‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিরা ব্রাজিল ছেড়েছেন। দোকান বিক্রি করে কিংবা ধার দেনা করে যে দিকে পারছেন চলে যাচ্ছেন। বেশ কিছু দেশে স্থায়ীভাবে চলে গেছেন। অনেকে আশাপাশের দেশে পাড়ি দিয়েছেন,’ তিনি যোগ করেন।

সাও পাওলোর শপিং কানিনদে মার্কেটের পাইকারি বিক্রেতা গাজীপুরের মো. আলমগীর হোসেন গত ৭/৮ মাস তার দুটি দোকানে লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ভাড়া, বিদ্যুত, স্টাফ খরচসহ মাসে গড়ে ৩০ হাজার ব্রাজিলিয়ান রিয়েস খরচ (১ রিয়েস বাংলাদেশি ১৬ টাকা) আছে। এখন মাসে গড়ে ৮ হাজার রিয়েস লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। আগে মাসে মুনাফা হতো বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।’

সাও পাওলো ছাড়াও ইস্প্রিত সান্তোস ও মিনাস জেরাইস রাজ্যে কাপড়ের ব্যবসা করেন কুমিল্লার ফরহাদ হুসেন ভুঁইয়া। তার ৫টি দোকানের মধ্যে ২টি বন্ধ হয়ে গেছে। অবস্থা যে দিকে যাচ্ছে বাকিগুলো বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না না বলে জানান তিনি।

পারানা রাজ্যের লন্ড্রিনা সিটির প্রবাসী হবিগঞ্জের সামশুল হক খোকন বলেন, ‘কোনো সহায়তা ছাড়াই আমরা বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছি। দুঃখ শুধু এতটুকু যে, বাংলাদেশ জানে না আমরা কী অবস্থায় দিন পার করছি। আমরাও রেমিট্যান্স পাঠাই, দেশ নিয়ে চিন্তায় থাকি।’

এজাজ মাহমুদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

2h ago