সাহিত্য

বিপ্লব আর অভাবের মিশেলে জন্ম নেয়া এক বারুদ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

ভালো ফলাফল নিয়েই অনার্সে ভর্তি হলেন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে। একদিন কলেজের ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে ভীষণ তর্ক। কোন এক বন্ধুর লেখা নাকি পত্রিকাতে ছাপায়নি। ফিরে এসেছে লেখা। সে বন্ধু আবার ভীষণ খ্যাপা। আরে যা যা নামী কেউ না হলে আবার পত্রিকায় লেখা ছাপে নাকি! পত্রিকাগুলো এখন বড় লেখক না হলে লেখা ছাপায় না। বন্ধুরা কেউ কেউ একমত প্রকাশ করলো। আরো বেশ কজন বন্ধুর মধ্যে একজন বলে বসলো, ‘আমিও পাঠিয়েছিলাম লেখা, কিন্তু পাত্তাই দিলো না! এরা সবটা এরকম। নামী লেখক না হলে যতো ভালোই লেখক হোক লেখাই ছাপায় না।’ তখন প্রতিবাদ করে উঠলেন প্রবোধকুমার, বললেন, ‘না এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল বলছো! তোমার গল্প ভালো হয়নি বলেই তারা ছাপেনি। পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপতো।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

ভালো ফলাফল নিয়েই অনার্সে ভর্তি হলেন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে। একদিন কলেজের ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে ভীষণ তর্ক। কোন এক বন্ধুর লেখা নাকি পত্রিকাতে ছাপায়নি। ফিরে এসেছে লেখা। সে বন্ধু আবার ভীষণ খ্যাপা। আরে যা যা নামী কেউ না হলে আবার পত্রিকায় লেখা ছাপে নাকি! পত্রিকাগুলো এখন বড় লেখক না হলে লেখা ছাপায় না। বন্ধুরা কেউ কেউ একমত প্রকাশ করলো। আরো বেশ কজন বন্ধুর মধ্যে একজন বলে বসলো, ‘আমিও পাঠিয়েছিলাম লেখা, কিন্তু পাত্তাই দিলো না! এরা সবটা এরকম। নামী লেখক না হলে যতো ভালোই লেখক হোক লেখাই ছাপায় না।’ তখন প্রতিবাদ করে উঠলেন প্রবোধকুমার, বললেন, ‘না এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল বলছো! তোমার গল্প ভালো হয়নি বলেই তারা ছাপেনি। পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপতো।’

বন্ধুও জবাব দিলো, ‘ছাড় ছাড়, ওসব সবাই বলে, কিন্তু এটাই বাস্তব।’

প্রবোধকুমার বললেন, আরে ভালো লেখা হলে ছাপাবে না কেন? অবশ্যই ছাপাবে।

বন্ধু পাল্টা জবাবে বললেন, ‘তবে প্রমাণ দিতে পারবি আমাকে? তুই একটা লেখা পাঠিয়ে দেখা তবে। দেখি ছাপা হয় কিনা!’

‘ঠিক আছে! বেশ, আমি আগামী তিন মাসের মধ্যে একটা গল্প লিখে কোনো একটা নামী পত্রিকায় ছাপিয়ে দেখাবো! বাজী ধরে নে।’ কিন্তু গল্প লিখতে গিয়ে থমকালো প্রবোধকুমার। জীবনে তো কখনো গল্প লিখতে বসেনি সে, কেবল পড়েছে। তিন মাস তো বহু দূর, তিন দিনের মধ্যেই গল্প লেখা শেষ। গল্পের শেষে নিজের নাম লিখতে গিয়ে একটা বার থমকালো প্রবোধকুমার। প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুরুতে প্রবোধকুমারের বদলে কি ভেবে যেন মায়ের দেয়া নাম মানিকই লিখলো সে। মূলত প্রবোধকুমারের বদলে মানিক জুড়ে দেয়ারও একটি গল্প আছে।

জীবনে প্রথম লেখা গল্প তার। পত্রিকার সম্পাদকের পছন্দ হবে সে বিষয়েও নিশ্চিত মানিক। কিন্তু ১২ কিংবা ১৩ বছর বয়সের মধ্যেই বাংলার সেরা সাহিত্যগুলো যার পড়া হয়ে গেছে সেই মানিক কিন্তু বুঝে গিয়েছিলেন “অতসী মামী” আসলে ‘অবাস্তব রোমান্টিকতায় ভরা’। আর সেই সংকোচেই প্রবোধকুমারের বদলে লিখলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সেই গল্প নিয়ে নিজেই হাজির ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার দপ্তরে।

সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সে সময় অফিসে ছিলেন না। তার জায়গায় বসেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। স্মৃতিকথায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত  লিখেছিলেন, ‘একদিন বিচিত্রার দফতরে কালোপানা একটি লম্বা ছেলে এলো। বলল গল্প এনেছি। বললাম, দিয়ে যান। সেই ছেলে লম্বা হাত বাড়িয়ে গল্পের পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলল, এই যে রাখুন। এমন ভাব যেন এখুনি ছাপতে দিয়ে দিলে ভালো হয়। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়ছে। গল্প জমা দিয়ে সে চলে গেল। আমি তারপর এমনিই গল্পে একবার চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ যে রীতিমতো দুর্দান্ত গল্প!’

সেই গল্প ছাপা হলো, মজার বিষয় হলো মানিকের চোখে অবাস্তব রোমান্টিসিজমে ভরা সেই গল্প পড়তে গিয়ে লুফে নিলো পাঠক সমাজ। এমনকি উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়  নিজেই হাজির হলেন মানিকের বাড়িতে। সঙ্গে গল্পের পারিশ্রমিক ২০ টাকা। আবদার, ‘এখন থেকে আপনি আমাদের পত্রিকায় গল্প লিখবেন।’

কলেজ ক্যান্টিনে গল্প ছাপা হওয়ার খবরে মহা সমারোহ। বন্ধুদের আবদারে ২০ টাকা গায়েব খাওয়াতে গিয়ে। বাজিতে জেতা, আবার সঙ্গে ২০ টাকা পারিশ্রমিক। মানিকের ইচ্ছে ছিল ত্রিশের আগে কোনো সাহিত্য চর্চা নয়, সেই তাকেই বাজি ধরে মাত্র আঠারো বছর বয়সে গল্প বুঁদ করে নিলো।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম বিহারের সাঁওতাল পরগণার দুমকা শহরে ১৯০৮ সালের ১৯ মে। বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্ট্রার, মা নীরদাসুন্দরী দেবী।

চার ভাইবোনের পর জন্ম হয়েছিল ঘুটঘুটে কালো গায়ের রঙের মানিকের। এমন গায়ের রং দেখে আঁতুড় ঘরেই নাম তার নাম রাখা হলো কালোমানিক। বামুনের ছেলে বলে কথা। রীতিমতো গণক ডেকে জন্মঠিকুজি তৈরি করা হয়েছিল। ঠিকুজিতে নাম রাখা হলো অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য এই নামে কেউ ডাকেনি তাকে।

এমনকি বাবা হরিহর সাধ করে ছেলের নাম রাখলেন প্রবোধকুমার। অবশ্য  ভালোবেসে কালোমানিক বলেই ডাকত সকলে।

বাবার বদলির চাকরির সুবাদে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইলসহ বহু জায়গায়। এদিকে তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের লৌহজং এর গাউদিয়া গ্রামে।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হাতেখড়ি হয়েছিল মানিকের। ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯২৮ সালে বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন মানিক। এরপর তো কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে ভর্তি হওয়া।

এই কলেজে পড়ার সময় বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি মানিকের। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে গল্প ছাপা হওয়ার পরে তো চলছে দিনরাত সাহিত্য চর্চা। কলেজের পড়াশোনা উঠলো লাটে। পরপর দু বছর বিএসসিতে করলেন ফেল। তখন তার পড়াশোনার খরচ জোগান বড় ভাই। ভাইয়ের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ও সাহিত্য চর্চা কানে গেছে তার। চিঠিতে ভাইকে লিখলেন তিনি, ‘তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে। গল্প লিখতে আর রাজনীতি করতে নয়! ফেল করেছো কেন?’

উত্তরে মানিক লিখলেন, ‘গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

ফিরতি চিঠিতে ভয়ংকর রেগে গিয়ে বড় ভাই বললেন, ‘তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি টাকা দিতে পারবো না। নিজেরটা নিয়েই দেখো!’

প্রতিউত্তরে মানিক লিখলেন, ‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’

তখন বয়স মাত্র ১৭, এর মধ্যে মাকে হারিয়েছেন, বড় ভাইও টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু সাহিত্য তাকে গ্রাস করে নিয়েছে পুরোভাগে।

শেষে কলেজের হোস্টেল ছেড়ে আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি মেসে উঠলেন মানিক। তখন তার বাবা মুঙ্গেরে ছোটভাই সুবোধের কাছে। দিনরাত এক করে নাওয়া খাওয়া ভুলে তখন মানিক শুধু লিখছেন, প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। নিজের শরীরের কথা ভুলে এই ভাবে অমানুষিক পরিশ্রমের ফলও ফলল কিছু দিন পরেই। অথচ ছোট বেলায় দারুণ কুস্তি লড়তেন মানিক, একা হাতে দশ জনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারতেন, সেই মানিক অসম্ভব পরিশ্রমে ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগলেন।

পদ্মা নদী মাঝির উপন্যাস লিখলেন কী করে? তাও এক বিস্তর কাহিনী। পদ্মা নদীর মাঝি ছিল মানিকের তৃতীয় উপন্যাস। অবশ্য সেই প্লটটা অনেকটা স্মৃতি থেকেই লেখা। সালটা ত্রিশের দশকের শুরুর দিকে। তখন বাবার চাকরির সুবাদে টাঙ্গাইলে থাকেন মানিকেরা। বাঁশি তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। মাঝেমাঝেই বাঁশি হাতে বেরিয়ে পড়েন একা। আদাড়েবাদাড়ে, নদীর ধারে ঘুরে বেড়ান মানিক সঙ্গে গান আর বাঁশি। বাড়ি ফেরার হুঁশ থাকে না তার। ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান কিংবা নৌকোর মাঝিদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে আড্ডা। কখনো কখনো আড়ালে এক দু'দিন থেকেও যান তাদের সঙ্গে। তখন বয়স ১৪ কিংবা ১৫ হবে তার। একদিন হঠাৎই বাড়ি থেকে নিখোঁজ। কয়েক দিন পেরিয়ে গেল মানিকের খবর নেই। বাড়ির সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। মা নীরা সুন্দরী দেবী তো কেঁদেকেটে অস্থির। অনেক খোঁজার পর মানিককে পাওয়া গেল টাঙ্গাইলের নদীর ধারে যে নৌকোগুলো নোঙ্গর করা রয়েছে, সেখানে মাঝিদের সঙ্গে। দুই বেলা তাদের সঙ্গে গল্প, গান খাওয়া-দাওয়া করে দিব্যি রয়েছেন মানিক। একটা সময় বুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো হলো তাকে। তখন আর কে জানতো এই স্মৃতিই পদ্মা নদীর মাঝি লেখার ক্ষেত্রে বড় কাজে দেবে! ১৯৩৬ সালে ছাপা হয়েছিল পদ্মা নদীর মাঝি।

সে বছর ছাপা হয়েছিল মানিকের আরেক বিখ্যাত উপন্যাস "পুতুল নাচের ইতিকথা" অবশ্য তা লেখা হয়েছিল আরো এক বছর আগে। সেই প্লটটাও আরেক কাহিনী।  ১৯৩৩ সালে কলকাতায় এসেছিলো এক বিখ্যাত পুতুল নাচের দল। সেই কার্নিভালের নাচ দেখে এমনই মুগ্ধ হলেন যে সেই পুতুলদের সঙ্গে মানুষের জীবনকে মিলিয়ে লিখতে শুরু করলেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। সেই উপন্যাস লিখতে বসে নিজের কথাই যেন ভুলে গেলেন মানিক। অনেক পরে এক চিঠিতে লিখেছিলেনও সেই কথা। যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘অপ্রকাশিত মানিক’ বইয়ের ২৪ নম্বর চিঠিতে দেখা যায় মানিক লিখেছেন, ‘প্রথমদিকে “পুতুলনাচের ইতিকথা” প্রভৃতি কয়েকটা বই লিখতে মেতে গিয়ে যখন আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা শরীর আছে এবং আমার পরিবারের মানুষরাও নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন একদিন হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। একমাস থেকে দু’তিন মাস অন্তর এটা ঘটতে থাকে। তখন আমার বয়স ২৮/২৯, চার-পাঁচ বছরের প্রাণান্তকর সাহিত্যসাধনা হয়ে গেছে।’

একসময় মানিক আক্রান্ত হলেন দূরারোগ্য মৃগীরোগে। শরীর আর সায় দিচ্ছে না। তার মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে চলছে লড়াই। নিজের রোগের সঙ্গে, চরম দারিদ্রের সঙ্গে। এই রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই শুরু করলেন অপরিমিত মদ্যপান। এর মধ্যেই চিকিৎসক বিধান রায়ের পরামর্শে বিয়ে করেছেন, ছেলে–মেয়ে হয়েছে। বাবাকে নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে। বরানগরে গোপাললাল ঠাকুর স্ট্রিটে সকলে মিলে ঠাসাঠাসি করে কোনো মতে তার থাকা। তার মধ্যেই চলে একের পর এক বিখ্যাত সব লেখা।

এতো সব  লেখালেখি করেও সংসার যেন আর চলে না। বাধ্য হলেন একটা পর্যায়ে  চাকরি নিতে। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে চাকরি ছেড়ে দিলেন। আবার পুরোদমে লেখা শুরু, সঙ্গে দারিদ্রতার লড়াই। সে দারিদ্র্য যে কী ভয়ংকর তা জানা যায় মানিকের ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা পড়লে। মানিকের স্ত্রী ডলি অর্থাৎ কমলা এক মৃত সন্তানপ্রসব করেছেন, আর মানিক ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’’ দারিদ্র্য কী অপরিসীম হলে মায়ের মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে আসে!

সংসারের এমন অবস্থায় আবার ঠিক করলেন তিনি চাকরি করতে হবে। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সাপ্তাহিক বিভাগের জন্য সহকারী সম্পাদক প্রয়োজন। মানিক আবেদন করলেন। জানতেন ওই পদের জন্যই আবেদন করবেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী। তাই নিজের আবেদনপত্রের শেষে সম্পাদককে লিখলেন, ‘‘আমি অবগত আছি পরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাহার সম্পর্কে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন।’’

চাকরি অবশ্য তারই হলো। মাসিক বেতন ঠিক হলো ৮৫ টাকা। সঙ্গে আবার শর্ত ‘অমৃতস্য পুত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। তার জন্য পাবেন আরও ১০ টাকা বেতন বেশি। কিন্ত তার ভাগ্যে যেন চাকরির কপাল নেই। সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন কিছু দিন পর। অভাব ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে, তার মধ্যেই লিখে চলেছেন, বামপন্থী ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কখনও একাই প্রাণের মায়া ছেড়ে একাই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন কলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা রুখতে।

১৯৫০ সালে যখন কমিউনিস্টদের ওপর নেমে এল চূড়ান্ত সরকারি দমন নীতি, তখন বহু পত্রপত্রিকায় মানিকের লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হলো। তখন নামলো আরো ভয়ংকর সঙ্কট। গোটা পরিবারের হাঁ মুখের দিকে তাকিয়ে আর যেন সহ্য হতো না কিছু। এক এক সময় ধিক্কার লাগত নিজের প্রতি। একসময় মদ খাওয়া ধরেছিলেন তিনি। সে মদ খাওয়া আরো তীব্র হলো। মদ ছাড়তে চেষ্টা করেও পেরে উঠছিলেন না। বাধ্য হয়েই বড় ভাইকে আবার চিঠি লিখলেন, কিছু টাকা ধার চেয়ে। যদি কিছু টাকা মিলে!

ভাই চিঠির উত্তরে লিখলেন, "আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, আমি কাউকে টাকা ধার দিই না।" এর মধ্যে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রকাশনার ব্যবসাও শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে সেই ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়লো।

একটা সময় অসুস্থ হয়ে ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত মানিক তখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। সঙ্গে চূড়ান্ত আর্থিক অনটন। তিনি মনে মনে কতটা ভেঙে পড়েছিলেন মানিক তা জানতে পারা যায় একটি ছোট ঘটনায়।

একদিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যার লেখা দিতে যাচ্ছেন রাস্তায় দেখা হলো অধ্যাপক দেবীপদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। মানিকের ভেঙে যাওয়া শরীর, ময়লাটে  জামাকাপড় দেখে খুব খারাপ লাগল দেবীপদ ভট্টাচার্য। তিনি বুঝলেন খাওয়া হয়নি মানিকের। জোর করে সে দিন নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত মানিককে খেতে দিলেন দেবীপদর মা। বড় তৃপ্তি করে ওই খাবারটুকু খেলেন মানিক।

একদিন মানিক সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন "আমি শুধু সাহিত্যিকই হব, কোন চাকরি করবো না, সাহিত্যই হবে আমার সমস্ত পথচলা  সেই মানিকই ভেঙে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’’

একটা সময় জিদ করে বাড়ি ফিরলেন তিনি। বন্ধু বান্ধবেরা তখন টাকা দিতে চাইলে নিতে মনে চায়নি তার। কিন্তু এর মধ্যেই বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়ার জন্য মামলা ঠুকেছে তার নামে থানায়। শেষমেশ নিতে বাধ্য হলেন মানিক। বাড়ির মালিক বললেন, ‘দিনের পর দিন ভাড়া বাকি রাখা আর সহ্য করবো না।’ এসময় মানিকের কয়েকজন বন্ধু মিলে মোটা টাকার বিনিময়ে আদালতে মামলার দিন পিছিয়ে দিতে পারলেন, কিন্তু জীবনের আদালতে রায় ঘোষণার দিন এগিয়ে আসছিল। শুনতে পায়নি কেউ। ৩০ নভেম্বর মানিক আবার জ্ঞান হারালেন অসুস্থতা আর দুশ্চিন্তায়। আর দুদিন পর তো  সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে।

এমন সময় অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে আসলেন কবি বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানিকের স্ত্রী কমলাকে দেখে বললেন, ‘বৌদি এমন অবস্থা, একটা বার ফোন করলেও পারতেন। জগতের সমস্ত নীরবতা ভেঙে ম্লান হেসে কমলার জবাব "ফোন করলেও যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।"

৩ নভেম্বর ভোর চার টায় চিরতরে চোখ বুজলেন মানিক। তার শেষযাত্রাটা উঠে এসেছিলো তার বন্ধু প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘পালঙ্ক শুদ্ধু ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা, একটা বন্ধ। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে ফুল। মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীরটা ফুলে আর ফুলে ছেয়ে গেছে। উপচে পড়ছে দুপাশে। মাথা এবং পায়ের কাছে দেশনেতা এবং সাহিত্যিক! সামনে পিছনে, দুই পাশে বহু মানুষ। সর্বস্তরের মানুষ। মোড়ে মোড়ে ভিড়। সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য। কিন্তু কাল কেউ ছিল না, কিছু ছিল না জীবনে এত ফুল তিনি পাননি কখনো।’

ঠিক যেন নিজের জীবনের স্বরূপ লিখেছিলেন মানিক তার বিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক গল্পের শেষভাগে। যেখানে লেখা, "পথে দুদিকে ধানের ক্ষেত আবছা আলোয় নিঃসাড়ে পড়িয়া আছে। দূরে গ্রামের গাছপালার পিছন হইতে নবমীর চাঁদ আকাশে উঠিয়া আসিয়াছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে শান্ত স্তব্ধতা। হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না!"

মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে দারিদ্র্যতার সঙ্গে চরম লড়াইয়ের পরও বাংলা কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে জন্ম নিয়েছিল ৪০টি উপন্যাস, তিনশর বেশি ছোট গল্প। আঘাতে প্রতিঘাতে, দারিদ্র্যের সঙ্গে আজীবন লড়াই করা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের বেশিরভাগ সময় ভালো খাওয়ার পয়সা ছিল না। চরম দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করেও সাহিত্য চর্চার থেকে দূরে সরতে পারেননি মানিক। তার জীবনের নাগাল হয়তো তাই বলেই কেউ পায়নি!

বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তী পথিকৃৎ সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম বার্ষিকী ছিল গতকাল। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বাংলা কথাসাহিত্যের এই মহীরুহ সাহিত্যিকের প্রতি।

তথ্যসূত্র:

সাহিত্য করার আগে- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়/ অঞ্জন আচার্য

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সাহিত্য/ ড. সরোজমোহন মিত্র

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়/ নিতাই বসু

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়/ কায়েস আহমেদ

মানিক জিজ্ঞাসা/ সম্পাদনা তরুণ মুখোপাধ্যায়

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago