হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি: কিন্তু তারপর কী?
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/afp_2.jpg?itok=8FGgYYI6×tamp=1621566450)
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সূচনা হয়েছে। গত ১১ দিন ধরে অব্যাহত সংঘাত এবং গাজায় ২৩০ জন ও ইসরায়েলে ১২ জনের মৃত্যুর পরে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয় গতকাল বৃহস্পতিবার। আজ শুক্রবার স্থানীয় সময় ভোররাত ২টায় তা কার্যকর হয়।
মিসর, কাতার ও জাতিসংঘের দূতরা এই মধ্যস্থতা করেন। কেননা, বিবদমান দুই পক্ষ পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয় না। আশু প্রশ্ন হচ্ছে এই যুদ্ধবিরতি কতটা কার্যকর হবে; তবে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এই সংঘাতকে কেন্দ্র করে যে সব ঘটনা ও প্রবণতা বোঝা যাচ্ছে তা ভবিষ্যতের কী ইঙ্গিত দেয়।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/gaza_afp_0.jpg?itok=d442PkaH×tamp=1621566713)
এই যুদ্ধবিরতি কতটা কার্যকর থাকবে সেটা নিয়ে সংশয় থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে ২০১৪ সালে একাধিকবার এই ধরনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙ্গে পড়েছিল; শেষ পর্যন্ত সংঘাত চলেছে ৫০ দিন। এখন এই সংঘাতে সাময়িক-বিরতি ঘটলেও মূল কারণগুলোর কোনো ধরনের সমাধান হয়নি। এমনকি, এই দফা সংঘাতের সূচনা হয়েছিল যেসব কারণে সেগুলোও অমীমাংসিতই থাকল।
জেরুসালেমে ফিলিস্তিনি কিছু পরিবারকে তাদের আবাস থেকে জোর করে উচ্ছেদ ও আল-আকসা মসজিদে ইসরাইলের সৈন্যদের হামলা থেকে এবার সংঘাতের সূচনা হয়।
এবারের এই সংঘাতের পেছনে আরও অনেক কারণ অবশ্যই আছে। যার মধ্যে সহজদৃষ্ট হচ্ছে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। বিশেষ করে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভাগ্য। তবে এটাই একমাত্র কারণ বললে ঘটনার আংশিক বর্ণনা দেওয়া হবে।
গার্ডিয়ানে গত ১৬ মে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সাইমন টিসডেল দেখিয়েছেন যে, এই সংঘাতের জন্যে দায়ী করা যায় অনেককেই— ইরান থেকে শুরু করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত। সেটা আমরা দেখতেও পেয়েছি, দায়ী করার ব্যাপারে কেউই পিছিয়ে থাকেননি।
এবারের এই সংঘাতে ক্ষতির বিবেচনায় আগের মতোই রয়েছে ব্যাপক অসমতা। গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহতদের অধিকাংশই হচ্ছেন বেসামরিক; তার মধ্যে আছে শিশুরা। অন্ততপক্ষে ১৭টি হাসপাতালের ক্ষতি হয়েছে, কোভিভ-১৯ এর একমাত্র টেস্টিং সেন্টার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে।
এ ছাড়া, গাজায় যে ভবনে মিডিয়া কেন্দ্রগুলো ছিল সেটা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে ইসরায়েলের ক্ষতি সামান্যই। ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা কার্যত সফল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থানুকূল্যেই এই ব্যবস্থার গবেষণা ও তৈরি। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র যৌথ গবেষণা ও উন্নয়নের নামে প্রতি বছর ইসরায়েলকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেয়। এটি ইসরায়েলকে দেওয়া হয় মার্কিন প্রতিরক্ষা সহায়তার বাইরে। সেই সহায়তার পরিমাণ বছরে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই সহায়তা আগামী ১০ বছর অব্যাহত থাকবে।
কিন্তু, গাজার হাসপাতালগুলো পুনর্নির্মাণের আশু সম্ভাবনা নেই। এই নিয়ে অর্থের ব্যবস্থা করা হবে দুরূহ। হাসপাতালের এই অবস্থার কারণে গাজার অধিবাসীরা যে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়লেন তা তাদের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার আরও অবনতি ঘটাল। এমনিতেই বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যখাতের যে দুর্বল অবকাঠামো ছিল তা ভেঙে দেওয়াকে কেনো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে না সেই প্রশ্ন তোলা যায়। এসব হামলায় ভেঙে পড়েছে স্কুল ও অন্যান্য স্থাপনা; গৃহহীন হয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়েছে।
এবারের এই সংঘাত দৃশ্যত ২০১৪ সালের মতোই। কিন্তু, এবার এই সংঘাতের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভিন্নভাবেও।
একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘাত। এটি আগে দেখা যায়নি। ইসরায়েলের ভেতরে ২০ শতাংশ হচ্ছেন আরব। তারা বিভিন্নভাবেই বৈষম্যের শিকার। তাদের ভেতরে ক্ষোভ আছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের ভেতরে উগ্র কট্টরপন্থিদের প্রভাব বাড়ছে। তাদের আচরণের কিছু ইঙ্গিত এবার পাওয়া গেল। এবারে গাজা, পশ্চিম তীর ও ইসরায়েলের ভেতরে থাকা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ঐক্য লক্ষ্য করা গেছে। এর বাইরেও যারা আছেন তারাও ফিলিস্তিনিদের পক্ষেই ছিলেন। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এটি এবার সহজেই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। এটি অবশ্যই হামাসের জন্যে ইতিবাচক, তাদের অবস্থান ও আবেদন শক্তিশালী হয়েছে। এই সংঘাতে এবং সংঘাত অবসানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান মাহমুদ আল আব্বাসের কোনো ভূমিকাই ছিল না। যারা হামাসকে বাদ দিয়ে ফিলিস্তিনিদের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ ভাবেন তাদের জন্যে এটা শিক্ষণীয়। কিন্তু, তারা এটা থেকে শিক্ষা নেবেন এমন মনে করার কারণ নেই। ২০১৪ সালের আগে বা পরেও নেননি।
পশ্চিমের দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র যার নেতৃত্বে, তারা যে এটা বুঝতে অনীহ বা অপারগ যে এই ধরনের হামলা এবং সংঘাত, বিশেষ করে ইসরায়েলের আচরণ যা হামাসের প্রতি সমর্থন বাড়ায়, তা তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যে ক্ষতিকর।
বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত যদি কোথাও দেখা যায় সেটা যুক্তরাষ্ট্রে। গত কয়েক দিনে দেখা গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের ভূমিকা এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা ইসরায়েলনীতি সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কিছু সদস্য এমনকি ইসরায়েলকে দেওয়া আর্থিক সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ কেউ সাময়িকভাবে হলেও তা বন্ধ করতে বলেছেন। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এসব কণ্ঠস্বর অত্যন্ত জোরালো। এটি ভবিষ্যতের জন্যে নিশ্চয় ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়।
এটাও লক্ষণীয় যে, হোয়াইট হাউস এক ধরনের চাপ অনুভব করেছে; যে কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনায় এক ধরনের বার্তা দিয়েছেন যাতে ‘সংঘাতের মাত্রা হ্রাসের’ কথা বলা হয়েছে।
একেবারে সহজভাবে দেখলে এটা একেবারে ব্যাপক কোনো ধরনের বার্তা নয়, কিন্তু, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে যারা অবহিত তারা বলছেন যে মার্কিন গ্রিন সিগন্যাল হলুদ হয়ে উঠছে। ইসরায়েল চায় না তা লালে পরিণত হোক।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো এরন ডেভিড মিলার ভ্যানিটি ফেয়ার’র এবিগেইল ট্রেসিকে সে কথাই বলেছেন। মিলারের রয়েছে দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্র বিষয়ক পর্যালোচনা ও মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ দিন কূটনীতিক থাকার অভিজ্ঞতা।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলনীতিতে ওয়াশিংটনে ইসরায়েল লবির প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু, বিভিন্ন সূত্রই বলছে যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপলব্ধি করছেন যে ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রথাসিদ্ধ নীতি এখন আর বহাল রাখা সম্ভব নয়। এটা একার্থে প্রজন্মগত পার্থক্য বলে একজন কূটনীতিক এবিগেইল ট্রেসিকে বলেছেন। তার সামান্য ইঙ্গিত হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযানের প্রতি সমর্থন আর বেশি সময় অব্যাহত রাখতে পারবে না। এটা নিঃসন্দেহে হতাশার জন্ম দেয় যে, বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা আগের যেকোনো প্রশাসনের চেয়ে ভিন্ন কিছু হলো না। কিন্তু, এটা ঠিক যে, হঠাৎ করে নাটকীয়ভাবে এই নীতি বদলাবে তা আশা করাও অবাস্তব। এই বিষয়ে ভবিষ্যতে কী হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এই যুদ্ধবিরতি সেই সুযোগ তৈরি করবে কি না সেটা আমরা লক্ষ্য করবো। ইসরায়েলের নেতারা এই পরিবর্তন নিশ্চয় উপলব্ধি করছেন, তারা কী করবেন সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত যেমন ইতিবাচক তেমনি মনে রাখা দরকার যে, গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে— সেটা ফিলিস্তিনিদের জন্যে আশার বিষয় নয়।
অনেকেই অভিযোগ করবেন যে, এই দেশগুলো আগেও কেবল কথার কথা হিসেবেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বলতো। বাস্তবতা হচ্ছে এখন সেটাও হ্রাস পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত এক সময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সরব ছিল। বেশ কিছু বছর ধরে ভারতের সেই অবস্থান নেই, নরেন্দ্র মোদির সরকার খোলামেলা ভাবেই ইসরায়েলের পক্ষে— আদর্শিক কারণে এবং রিয়েলিস্ট পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে।
ফিলিস্তিনিরা এই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করে কোন পথে পা বাড়ান সেটাও নির্ধারণ করবে আগামীতে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী আছে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
Comments