কারাগারে রোজিনা: ‘ভিডিও ফাঁসের কারণে জামিন পেতে দেরি’

সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। ছবি: আনিসুর রহমান

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন আবেদন করা হলে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করে আরও বেশি সময় চেয়ে আবেদন করেন। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. বাকী বিল্লাহ তা মঞ্জুর করে আগামী রবিবার আদেশের দিন ধার্য করেছেন।

সরকারি কৌঁসুলিরা এসময় নতুন ভিডিও উপস্থাপন করবেন। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিনের শুনানির আগের রাতে যেটি রহস্যজনকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

সচিবালয়ের যে কক্ষে রোজিনাকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হেনস্তা করছিলেন, সেই কক্ষে উপস্থিত থাকা একজন এ ভিডিও ফুটেজটি ধারণ করেন। এরপর বুধবার রাতে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হেমায়েত উদ্দিন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা আদালতকে অনুরোধ করেছি, রোজিনার জামিন আবেদনের আদেশ আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে। যাতে এ সময়ের মধ্যে আমরা আদালতের কাছে প্রমাণ হিসেবে ভিডিওটি জমা দিতে পারি।’

এছাড়া, তারা অন্যান্য প্রমাণও জমা দেবেন বলে জানান তিনি।

সাত মিনিটের ভিডিওতে দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং কর্তব্যরত পুলিশ রোজিনাকে জেরা ও নির্যাতন করছেন, আর তিনি বর্ণনা করছেন কীভাবে একটি সোর্সের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষে প্রবেশ করেছেন।

জেরার এক পর্যায়ে রোজিনা ইসলাম বলেন, ‘আমি একটি ভুল করেছি এবং আমি এ ব্যাপারে লিখিত মুচলেকা দিতে চাই।’

তবে, ওই ভিডিওতে মন্ত্রণালয়ের ভেতরে রোজিনাকে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার ঘটনার মাত্র সাত মিনিট দেখানো হয়েছে। তাছাড়া ওই নির্দিষ্ট ভিডিও ক্লিপটি ‘অজ্ঞাতনামা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা’ গতকাল ছড়িয়ে দিয়েছেন।

রোজিনার ভাগ্যে কী হতে যাচ্ছে, তার নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই ভিডিও ক্লিপটি। কারণ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করছেন, ওই ভিডিওটি প্রমাণ করেছে রোজিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোতে তিনি দোষী।

অপরদিকে, রোজিনার পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি দেন- একজন ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতে, চাপের মুখে রোজিনা যাই বলে থাকুন না কেন—সেটা তথ্য-প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

রোজিনার পক্ষের আইনজীবী ছিলেন- এহসানুল হক সমাজী, আশরাফ–উল আলম, আমিনুল গনি টিটো, প্রশান্ত কর্মকার, আবদুর রশিদ ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তারা জানান, ওই ভিডিওটি আদালতের ধর্তব্যে আনা যাবে না। কারণ পুলিশের করা প্রথম এজাহারের ভিত্তিতে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। সেখানে এই ভিডিওর কোনো উল্লেখ নেই।

এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘রোজিনার একটি ব্যক্তিগত বক্তব্যকে বিচার প্রক্রিয়ায় বিবেচনা করা যাবে না।’

এর উত্তরে, রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে অনুরোধ করেন প্রমাণ হিসেবে ভিডিওটি জমা দেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিতে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ভার্চুয়াল আদালতে শুনানি শুরু হয় এবং প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে। শুনানির পর ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আরও দুঘণ্টা সময় নেন।

আসামিপক্ষ: রোজিনা কেন জামিন পাওয়ার যোগ্য

‘অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পাওয়ার যোগ্য। কারণ তিনি অজামিনযোগ্য কোনো অপরাধ করেননি’, শুনানিতে বলেন, অ্যাডভোকেট সমাজী।

‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩-এর ১২ নং ধারায় বলা হয়েছে অ্যাকিউজড ‘শ্যাল বি’ গিভেন বেইল।’ অর্থাৎ ইংরেজি শব্দ ‘শ্যাল’ এর ব্যবহার রোজিনাকে জামিন পাওয়ার আইনগত অধিকার দিয়েছে।

আসামিপক্ষ আরও যুক্তি দেন যে, রোজিনাকে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ এবং ‘অবৈধ যোগাযোগের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করার পেছনে কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

আবদুর রশীদ বলেন, ‘সচিবালয় কোনো নিষিদ্ধ এলাকা নয়। নিষিদ্ধ এলাকা বলতে সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষিত নিষিদ্ধ এলাকা হতে হবে।’

আসামিপক্ষ আরও উল্লেখ করেন, রোজিনার কাছে সে ভবনে প্রবেশ করার জন্য একটি বৈধ পাশ ছিল এবং তিনি অনুপ্রবেশকারী ছিলেন না।

সমাজী বলেন, ‘যদি কোনো চুরির ঘটনা ঘটেও থাকে, সেক্ষেত্রে চুরি হওয়া উপকরণের কোনো বর্ণনা এজাহারে নেই। তাদেরকে জানাতে হবে কোন গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরির অভিযোগে তারা তাকে অভিযুক্ত করছেন।’

রাষ্ট্রপক্ষ জোর দিয়ে বলেন, রোজিনা চীন ও রাশিয়া সংক্রান্ত গোপন নথি সংগ্রহ করছিলেন এবং তার ‘শরীরের বিশেষ অংশে’ সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

আসামিপক্ষ প্রত্যুত্তরে জানিয়েছেন, ‘গোপন নথি’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

তারা বলেন, ‘নথি শুধু সরকারি অথবা ব্যক্তিগত হতে পারে। রাইট অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট সবাইকে সরকারি নথি দেখার ও পড়ার অধিকার দিয়েছে। সর্বপোরি, ভ্যাকসিন সংক্রান্ত নথির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা জড়িত থাকতে পারে না।’

আশরাফ–উল আলম বলেন, ‘পুরো মামলাটিই বানোয়াট এবং রাষ্ট্রপক্ষের হাতে এই মামলাটি সাজানো এবং মিথ্যে তথ্যপ্রমাণ তৈরির জন্য প্রচুর সময় ছিল।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটেছে দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে, আর মামলা দায়ের করা হয়েছে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে। অথচ মন্ত্রণালয় থেকে থানার দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিটের।’

আমিনুল গনি টিটো বলেন, ‘এজাহার অনুযায়ী, অভিযোগকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন দেখে এতক্ষণ দেরি হয়েছে।’

তিনি প্রশ্ন করেন, ‘মন্ত্রণালয় ভবনেই সচিব এবং মন্ত্রী বসেন। তাহলে কারা এই ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা’, যাদের কাছ থেকে তারা নির্দেশনা পাচ্ছিলেন?’

দ্য ডেইলি স্টারের জোগাড় করা জব্দ তালিকায় দেখা যায়, রোজিনার কাছ থেকে ‘জব্দ’ করা সব উপকরণই প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগমের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

সবশেষে সমাজী বলেন, ‘যেহেতু কী বস্তু নেওয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো বর্ণনা নেই এবং অবৈধ যোগাযোগের কোনো প্রমাণ বা তা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই, নিঃসন্দেহে এখানে আইনের অপব্যবহার ঘটেছে।’

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘যিনি মামলাটি দায়ের করেছেন (স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী) তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শীও নন।’

‘তারা আইন ব্যবহার করে সাংবাদিকদের অপরাধী বানানোর চেষ্টা করছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এজাহারটিকে অবজ্ঞা করে তাকে জামিন দিন। আমরা ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, তিনি প্রতিটি শুনানিতে উপস্থিত থাকবেন।’

রোজিনার আইনজীবীরা উল্লেখ করেন, গত ৫০ বছরে ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ আইনের আওতায় একটি মামলাও দায়ের করা হয়নি।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এর জবাবে বলেন, ‘আমরা এরকম কোনো মামলা দেখিনি, কারণ গত ৫০ বছরে এ ধরনের কোনো ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হয়নি।’

যখন রোজিনার আইনজীবীরা যুক্তি দেন তিনি একজন অসুস্থ নারী এবং জামিনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটার হেমায়েত বলেন, ‘ঘসেটি বেগমও একজন নারী ছিলেন।’

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের জন্য কুখ্যাত ঘসেটি বেগম।

তিনি বলেন, ‘যদি তিনি জামিন পান, তাহলে তিনি তথ্য-প্রমাণ বিকৃত করবেন এবং সাক্ষীদের প্রভাবিত করবেন। মামলাটি শুরু হবার আগে থেকেই তিনি এটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।’

সোমবার শিব্বির আহমেদ ওসমানীর দায়ের করা মামলার কারণে রোজিনা বর্তমানে কারাগারে আছেন।

তার অভিযোগে শিব্বির জানান, বাংলাদেশ বর্তমানে একাধিক দেশের সঙ্গে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কেনার জন্য আলোচনা চালাচ্ছে এবং এ সংক্রান্ত কিছু ‘নন-ডিসক্লোজার চুক্তি’ হয়েছে।

পরে ঢাকার একটি আদালত রোজিনার রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করার পর মঙ্গলবার তাকে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

তার আগের দিন রোজিনাকে সচিবালয় ভবনের ভেতরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অংশে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়। এরপর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পুলিশ তাকে উল্লিখিত মামলার ভিত্তিতে গ্রেপ্তার দেখায়।

মহামারিকালে রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

আরও পড়ুন:

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেছার বিরুদ্ধে তদন্ত: দুদক

সাংবাদিক রোজিনার জামিন আদেশ রোববার

সাংবাদিক রোজিনার জামিন শুনানি শেষ, দ্রুততম সময়ে আদেশ

রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি, দোষীদের শাস্তির দাবি নোয়াবের

কেন তিনি ৩ দিন কারাগারে থাকবেন

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তি চায় রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডারস

কারাগারে রোজিনা, সংকটে সাংবাদিকতা

রোজিনা ইসলামকে হেনস্তায় জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করা উচিত ছিল: ফখরুল

সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্তা: সাংবাদিকদের বিক্ষোভ, বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা

সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্তা: ১১ নাগরিকের বিবৃতি

সাংবাদিক রোজিনার রিমান্ড নামঞ্জুর, কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ

সাংবাদিক রোজিনা আদালতে, ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন

সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্তা: শাহবাগ থানার সামনে সাংবাদিকদের বিক্ষোভ

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে থানায় নেওয়া হয়েছে

সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago