এসএমই উদ্যোগ টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনা পুরোপুরি বাস্তবায়নের আহ্বান

কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের (সিএমএসএমই) উদ্যোগ টিকিয়ে রাখতে সরকারের বর্তমান প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত এবং একইসঙ্গে আসন্ন বাজেটে এসব উদ্যোগের জন্য আরেক দফা সহায়তা বরাদ্দ করা উচিত বলে মত দিয়েছেন উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
cmsme-entrepreneurs-1.jpg
স্টার ফাইল ছবি

কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের (সিএমএসএমই) উদ্যোগ টিকিয়ে রাখতে সরকারের বর্তমান প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত এবং একইসঙ্গে আসন্ন বাজেটে এসব উদ্যোগের জন্য আরেক দফা সহায়তা বরাদ্দ করা উচিত বলে মত দিয়েছেন উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা।

পাশাপাশি, করোনা মহামারির কারণে সংকটে পড়া সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) কমানো এবং ব্যাংকিং সেবা পাওয়ার জন্য এ খাতের একটি সঠিক ডাটাবেজ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

অন্যান্য বিভাগের জন্য বরাদ্দ তহবিল বিতরণ ইতোমধ্যে শেষ পর্যায়ে থাকলেও, এখন পর্যন্ত সিএমএসএমই’র ২৩ হাজার কোটি টাকার তহবিলের ৭৩ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে।

সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই ঋণ নেওয়ার কঠিন শর্ত পূরণ করতে না পারায় তাদের ঋণ গ্রহণের হারও কম।

এ ছাড়া, সিএমএসএমই’র যথাযথ কোনো সংজ্ঞা না থাকার পুরনো সমস্যাটি গত বছরের এপ্রিলে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

করোনার কারণে সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছেন। বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে এসব ব্যবসার ১৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে হাজার হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এ ছাড়া, আরও ৫০ শতাংশ সিএমএসএমই ব্যবসাকে টিকে থাকার লড়াই চালাতে হচ্ছে।

এমন একজন সিএমএসএমই উদ্যোক্তা হচ্ছেন মো. মোকাররম হোসেন। সাভারের হেমায়েতপুর ভিত্তিক ছোট আকারের চামড়ার জুতা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সুপার ফিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। মহামারির মধ্যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি কর্মীর সংখ্যা ১২ জন থেকে কমিয়ে তিন জনে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

মহামারির আগে তার ২০ লাখ টাকার মাসিক বিক্রি থাকলেও, এখন কমে তা মাত্র ৫০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। মোকাররম হোসেন ঋণ পাওয়ার জন্য উপযুক্ত কি না তা বুঝতে ব্যাংক কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার তার কারখানা পরিদর্শন করেছেন। তবুও, কঠিন শর্ত ও বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে তিনি কোনো ফান্ড নিশ্চিত করতে পারেননি।

ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ২০০৮ সালে কোম্পানিটি শুরু করা মোকাররম হোসেন বলেন, ‘এখন আমাকে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করা ছেড়ে দিতে হবে। আমি চাকরি খুঁজছি।’

হাজারীবাগ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্মার্ট লেদার প্রোডাক্টসের মাসুদা ইয়াসমিন অবশ্য ঊর্মি কিছুটা ভাগ্যবান ছিলেন। প্রণোদনা তহবিল থেকে ২০ লাখ টাকা পেয়েছেন তিনি।

তবে ওই টাকা কয়েক ধাপে বিতরণ করায় তিনি এর সঠিক ব্যবহার করতে পারেননি। টাকার কিছু অংশ ঋণ পরিশোধের কাজেও ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসায় ঊর্মি এখন অনলাইনে ব্যবসা করেন।

আয় কমে যাওয়ায় মাসে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে ডিজাইন বাই রুবিনার মালিক রুবিনা আক্তার মুন্নির জন্যও।

তিনি বলেন, ‘সরকারের ক্ষুদ্র উদ্যোগের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত। কারণ এগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।’

এগ্রো মেশিনারি ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক শেখ সাদিও একই কথা বলেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘পরবর্তী বাজেটে কোভিড-১৯ বিপর্যয় থেকে সিএমএসএমইগুলোকে উদ্ধারের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’

‘জামানতমুক্ত তহবিল এবং ব্যবসাকে নতুন নতুন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে প্রসারিত করার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে এ কাজটি করা যেতে পারে। সরকার তাদের ভ্যাট ও অগ্রিম আয়করের বোঝাও কমিয়ে দিতে পারে’, বলেন তিনি।

রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘৬৬ শতাংশ সিএমএসএমই ব্যবসা প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য আবেদনই করেনি। যারা আবেদন করেছে, তাদের মাত্র ৪৫ শতাংশ এখন পর্যন্ত ঋণ পেয়েছে।’

পরবর্তীতে খাতটিকে দেওয়া প্রণোদনা পুরোপুরি ব্যাংক নির্ভর হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ডিসিসিআই প্রধান। এ তহবিল এসএমই ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন ও অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে সঠিকভাবে বিতরণের পরামর্শ দেন তিনি। 

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম সিএমএসএমই’কে দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা দেওয়ার এবং একটি যথাযথ ডাটাবেজ প্রস্তুত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি সিএমএসএমই যথাযথ কোনো ডাটাবেজে নিবন্ধিত নয়। ফলে তারা বিভিন্ন সরকারি সুবিধা ভোগ করতে পারছে না।’ 

এ খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল থেকে গত ৬ মে পর্যন্ত প্রায় ৯২ হাজার ৮০০ সিএমএসএমই ১৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছে।

ফেরদৌস আরা বেগম ভ্যাট হার কমানো এবং বিতরণ মেয়াদ বাড়ানোরও দাবি জানান।

এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মাসুদুর রহমান জানান, এসএমই ফাউন্ডেশন এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা পেয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি নয়টি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জুনের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা বিতরণের পরিকল্পনা করেছে। ফাউন্ডেশনটির লক্ষ্য অল্প সুদে নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকা বিতরণ করা। 

বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো যেন সিএমএসএমই’র বাজার দখল করতে না পারে, সেজন্য নীতিমালা তৈরি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. আলী জামান। 

জামান বলেন, ‘শিল্প সংগঠনগুলো বর্তমানে এমন পণ্য উৎপাদন করে, যেগুলো সিএমএসএমইও তৈরি করে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে লালবাগ, বাড্ডা, দনিয়া ও পুরান ঢাকার কয়েক হাজার সিএমএসএমই ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) তাদের বাজেট প্রস্তাবনায় সরকারকে সিএমএসএমই’র জন্য জামানতমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছে।

সিএমএসএমই’র জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশংসাও করেছে এফবিসিসিআই।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments