আমাদের জাগরণের প্রথম সুর তোলেন নজরুল: অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একজন লেখক, ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক ও শিক্ষক। তার জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের মতলব উপজেলার কলমাকান্দায়। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের ইমেরিটাস অধ্যাপক তিনি। বাংলাদেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল গবেষক হিসেবে তিনি সম্মানিত।
নজরুল গবেষণায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় ধরে। তার অন্যতম কাজ জাতীয় কবির সবচেয়ে তথ্যবহুল জীবনীগ্রন্থ রচনা, নজরুল নির্দেশিকা, নজরুলের সুস্থাবস্থায় করা গানের স্বরলিপি উদ্ধার, কবির হস্তলিপি ও দুর্লভ আলোকচিত্র সংগ্রহ।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের অসংখ্য দুর্লভ ছবি তুলেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
সমাজ-রাষ্ট্রের অসামান্য অবদানের জন্যে তাকে ‘স্বাধীনতা পদক’, ‘একুশে পদক’, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ ও ‘নজরুল একাডেমি পুরস্কার’ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ১৯ জুন তাকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
নজরুলের জন্মদিন নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
নজরুল নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘ সময়। কীভাবে এলেন নজরুল ভুবনে। এর আগে কেউ কি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় এসেছিলেন?
ব্যক্তিগত উদ্যোগে নজরুল নিয়ে কবি আবদুল কাদির অনেক কাজ করলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি শুরু করি ১৯৫৭ সালে। আমার শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাই স্যারের নির্দেশনায়।
মাস্টার্স শেষে স্যার বললেন, নজরুল নিয়ে একাডেমিক গবেষণা হয়নি, গবেষণা হওয়া দরকার। তুমি পিএইচডি করো। এভাবে কাজ শুরু করি।
প্রথমে চলে যাই কলকাতায়। সেখানে শহরের অলিগলিতে তাকে জানাশোনা মানুষের খোঁজ করি। কমরেড মোজাফফর আহমেদ, কবি আবদুল কাদিরসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলি। নজরুলের গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় যাই। তার পরিবার, প্রতিবেশী ও আসানসোলের অগ্রজদের সাক্ষাৎকার নেই। নানা তথ্যের ক্রস চেক করি। তারপর নতুন তথ্য তুলে ধরতে থাকি।
এর মধ্যে আমার ফুলব্রাইট স্কলারশিপ হয়। আবার এসে নজরুলের ওপর পিএইচডির কাজ করব— এই শর্তে ছুটি পাই। চলে যাই ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণা বিষয়ে আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর মিনেসোটা, মিশিগান-অ্যান আরবার ও হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারে গবেষণা করি। ফিরে এসে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি নজরুলের জীবন ও কবিতা বিষয়ে।
তারপর, নজরুল রচনার কালানুক্রমিক ও বর্ণনাক্রমিক হিসেবে রচনা করি নজরুল নির্দেশিকা। বাংলা একাডেমি এটা প্রকাশ করেছে।
নজরুলের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে? দেখা হলে তা কোথায় ও আলাপের বিষয় যদি জানাতেন।
১৯৫৮ সালে কলকাতায় নজরুলের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। যতদূর মনে পড়ে তখন তার বাসা ছিল শ্যাম বাজারের দিকে। কবি শুয়ে আছেন, কথা বলতে পারেন না। তাকিয়ে থাকেন ফ্যালফ্যাল করে। তার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে প্রকাশকরা তাদের ঠকাচ্ছে, গ্রামোফোন কোম্পানি হিসাব দিচ্ছে না ইত্যাদি।
নানা কারণে নজরুল ঢাকায় আসতে চাইলে কবিকে পাকিস্তান সরকার আসতে দেয়নি। এর মধ্যে আমি যতক্ষণ সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম নজরুল শান্তভাবে বসেছিলেন। অসহায় লাগছিল তাকে। আমার অস্বস্তি লাগছিল। বিদ্রোহী কবিকে এমন দেখব প্রত্যাশা করিনি। কারণ, আমাদের জাগরণের প্রথম সুর তোলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
তারপর নজরুলের ছেলে কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধের সঙ্গে আলাপ করেছি। তখন প্রায় এক মাস কলকাতা ছিলাম। সেসময় নজরুলের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করতাম প্রায় প্রতিদিনই। যখনই যেতাম কোনো না কোনো নতুন তথ্য পেতাম। সেগুলো জীবনীগ্রন্থ রচনা ও নজরুল নির্দেশিকায় কাজে আসে।
বাংলাদেশে নজরুল নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অগ্রগতি কেমন? কতটা মানসম্মতভাবে তাকে জানা যাচ্ছে?
১৯৫৮ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক, আমারই তত্ত্বাবধানে ‘নজরুল-গবেষণা কেন্দ্র’ থেকে চার গবেষক নজরুলের নানা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এর বাইরে লেকচার সিরিজ চালু ছিল। এতে দেশ-বিদেশের লেখক-গবেষকরা আসতেন, আলোচনা হতো। গবেষণার পাশাপাশি প্রকাশনা হতো। ক্রমান্বয়ে মান কমে যেতে শুরু করে। এখন তো আমি নেই, তাই জানি না এখন ঠিক কেমন চলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল অধ্যাপক পদ চালু হয়, চালু হয় গবেষণা কেন্দ্রও। এর বাইরে অন্যান্য বিভাগেও গবেষণা হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় নজরুল ইনস্টিটিডট, বাংলা একাডেমি, নজরুল গবেষণা কেন্দ্র ও ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে নজরুলের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা হয়।
আমারই তত্ত্বাবধায়নে বাংলা একাডেমি ও নজরুল ইনস্টিটিডটে অনেক কাজ হয়েছে। গবেষণার বৈচিত্র্য দেখে প্রকাশ করেছি ভালো-ভালো বই। কাজী নজরুল ইসলামের গীতি সাহিত্য। নজরুলের জীবন ও সৃষ্টি, ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন’ উল্লেখযোগ্য।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত আপনার ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন’ বইটি দেখেছি। অসংখ্য বানান ভুল। এটা কীভাবে হলো? সম্পাদনা বা প্রিন্টে কি কেউ নেই সেখানে?
এটা তো অনেক আগে বের হয়েছে, বেশ বড় বই। সম্ভবত চতুর্থ সংস্করণ দেখেছেন। বই ছাপা বা নতুন সংস্করণ বের হলে আমাকে দেখানোর কথা। তা হয়নি। বর্তমানে বইটি কীভাবে ছাপছে সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তবে এটি আপনার আগে একজন জানিয়েছিলেন। ফলে বইটি বাজার থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছে। আরও সর্তক হয়ে কাজ করার কথা বলেছি। নজরুলের কোনো রচনা যেন বিকৃত না হয়, তা বলে দিয়েছি।
নজরুল গবেষণায় নানামাত্রিকতায় ঋদ্ধ আবদুল কাদির। আপনি তার সঙ্গেও কাজ করেছেন। নজরুল নিয়ে তার কাজের মূল্যায়ন কীভাবে করেন?
আবদুল কাদিরের মতো গবেষক একটি দেশে কমই হয়। তার নজরুল চর্চা ও গবেষণার পরিধি বহু বিস্তৃত। নজরুলের আলোচনায় তার নাম অনিবার্যভাবে আসে। নজরুলের যে ছন্নছাড়া জীবন, সে জীবনে আবদুল কাদির না থাকলে নজরুল রচনাবলী হারিয়ে যেত। এটি পাকিস্তান সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড (বর্তমান বাংলা একাডেমি) থেকে প্রকাশিত হয়। রচনাবলীর বাইরেও তার প্রবন্ধ নানামাত্রিকতায় ঋদ্ধ বলা যায়।
দেশভাগের আগেই নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্মের তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান, সংগ্রহ ও গবেষণার কাজ অনেকটা করেছেন আবদুল কাদির। তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে। কিন্তু, আপনার নামের সঙ্গে ভাষা সৈনিক ব্যবহার কম দেখা যায়। তার কোনো আলাদা ব্যাখ্যা আছে?
ভাষাসৈনিক আবার কী! বলা যায় ভাষাকর্মী বা ভাষা-সংগ্রামী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু মানুষ শব্দটা চালু করেছেন। এরা মূলত বাহাদুরি নিতে চেয়েছেন। ভাষাসৈনিক শব্দটা কারোই ব্যবহার করা উচিৎ নয়। সেসময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ কোটি। ছোট-বড় সবাই তো ভাষা সংগ্রামে ছিল। উৎকণ্ঠায় ছিল অস্বস্তি নিয়ে।
দেশভাগের পরেই ভাষার দাবি বেগবান হয়। তবে ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চালানোর পর দেশের মানুষের আবেগ এমনভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল যে, ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সবাই রাজপথে ছিলেন। কেউ কারফিউ মানেননি। সবাই তো ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছেন। আমরা কয়েকজন ওখানে উপস্থিত ছিলাম, আর অমনি ভাষাসৈনিক হয়ে গেলাম? আমি এটা মানি না।
আপনি ভাষা আন্দোলনের অসংখ্য দুর্লভ ছবি তুলেছিলেন। বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছিল? কী আবেগ কাজ করেছিল ছবি তোলার পেছনে?
বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার। বাবার কর্মসূত্রে আমরা ঢাকার রেলওয়ে কলোনিতে থাকতাম। ১৯৪৮ সাল থেকেই দেখছি— আন্দোলনকারীরা, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন শিক্ষার্থী, মিছিলে অংশ নিচ্ছেন। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি।
১৯৫১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হলাম। তারপর ছাত্র হিসেবে আমি বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতি আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়ি। আমিও মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিই। এর ফাঁকে ছবি তুলি। সময়কে ধরে রাখি। সেসময় আমার একটা ভোগল্যান্ডার ক্যামেরা ছিল, ওটা সেসময় কাজে লেগেছিল।
Comments