নারী সাংবাদিকতা-স্বাধীনতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম ও বেগম পত্রিকা
বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থেকে সম্পাদনা সমস্তই যাত্রা শুরু করেছিল তার হাত ধরে। বাংলাদেশ তো বটেই উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম। তার সম্পাদিত বেগম পত্রিকা ছিল প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক। যে পত্রিকায় নূরজাহান বেগম তার সম্পাদনায় তুলে আনলেন নারী জাগরণ, নারী স্বাধীনতা থেকে নারী অধিকার। যেখানে উঠে এসেছিল কুসংস্কার বিলোপের কথা, গ্রামগঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠিও। প্রকৃত নারী অর্থেই "বেগম" ছিল নারী প্রগতি, স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে অদম্য এক মাধ্যম। বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে সর্বমহলের নারীর ভাষ্য তুলে এনেছিলেন নূরজাহান বেগম। তার দেখাদেখি ধীরে ধীরে বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতার পথ বিস্তৃত হয়েছিল, বেগম পত্রিকায় লেখনী ও পাঠের মধ্য দিয়ে নারীরা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সজাগ হয়ে উঠেছিলেন। তার দেখাদেখি বাংলাদেশের নারীদের সাংবাদিকতায় আসার পথ সুযোগ হয়েছিল।
নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে। তাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল অবশ্য পাইকারদী গ্রামে। কিন্তু সেই গ্রাম মেঘনার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেলে, তার বাবা চালিতাতলিতে বাড়ি করেন। তার বাবা মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বিখ্যাত সওগাত পত্রিকার সম্পাদক। মা ফাতেমা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তার জন্মের সময় তার বাবা ছিলেন কলকাতায় বিমা কোম্পানিতে চাকরিরত।
নূরজাহান বেগমের শৈশবের প্রথমভাগ কেটেছিল চালিতাতলি গ্রামেই, তার মা, মামা, দাদী, নানীদের মধ্যে। তিনি ছিলেন ভীষণ চঞ্চল। তাকে সামাল দিতে ও তার চঞ্চলতা থামাতে পরিবারের সদস্যদের বেগ পেতে হতো। তখন তার বাবা কলকাতায়। মাঝে মাঝে বাবা বাড়িতে বেড়াতে এলে বাবার ছোট্ট নূরী কোল থেকে নামতেই চাইতো না। নূরী নামটা রেখেছিলেন তার বাবা।
সবাই সেই নামেই ডাকতো, অবশ্য চাচীরা তাকে ডাকতো নুরুননেছা বলে। ছোটবেলায় ভীষণ চঞ্চল ছিল। একবার পুকুরে ও একবার খালে পড়ে যাওয়া ঘটনা ঘটে।
এদিকে তার বাবা দুই দফা এমন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে শঙ্কিত বোধ করলেন। তিনি দ্রুত বাড়িতে এলেন। বললেন নূরী ও স্ত্রীকে তিনি কলকাতা নিয়ে যাবেন। নিজের কাছে রাখবেন, এখানে তাকে রাখা বিপজ্জনক। তখন নূরীর বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। অবশেষে নূরী তার মামা ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে রওয়ানা দিলো কলকাতার উদ্দেশ্যে। প্রথমে চাঁদপুর থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ, এরপর গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ট্রেনে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে। সেখানে নাসিরউদ্দীন নিজেই এসেছিলেন। তাদের নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি টমটম এসে থামল ১১, ওয়েলেসলি স্ট্রিটের এক দোতলা বাড়ির নিচে।
দোতলায় থাকেন নাসিরউদ্দীন আর নিচতলায় সওগাত প্রেস। কলকাতায় আসার পর নূরীর নাক ও কান ফোটানো হলো স্যাকরার দোকানে। মূলত কলকাতার জীবনের সঙ্গে যেন মানিয়ে চলতে পারে মেয়ে সে জন্যই। কেবল এখানেই নয়, মাথার লম্বা চুল জলাঞ্জলি দিতে হলো এক সেলুনে নিয়ে। এর মধ্যে নূরীর খাতির হয়ে গেল পাশের বাড়ির এক ইংরেজ পরিবারের দুই সন্তানের সঙ্গে। একজনের নাম টিটু অন্যটির নাম লডেন। যদিও ভাষার প্রতিবন্ধকতা ছিল তাদের মধ্যে কিন্তু কদিনের মধ্যেই দারুণ খাতির হয়ে যায়। এদিকে নূরীও তাদের সঙ্গে মিশে ইংরেজি আয়ত্ব করে ফেলছে। এর কিছুদিন পরে নূরীকে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো। স্কুলের ভর্তির সময় তার নাম নূরীর বদলে দেয়া হলো নুরুন্নাহার। আরেকবার তার নানী তাদের ওয়েলসলি স্ট্রিটের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। নানী আদর করে নাতনীর নাম রাখলেন নূরজাহান।
তাদের এই বাড়িটা ছিল চাঁদের হাট। এই বাড়ির উপরের তলায় একপাশে থাকতেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, অন্যপাশে নজরুল। নিচতলায় প্রেস। নজরুল খুব চঞ্চল ছিলেন, হৈ হুল্লোড় গান বাজনা গাইতেন। আর তাতে পাশে বসে গান শুনতো নূরী।
এই বাড়ির প্রতিটি আড্ডায় ছিল নূরী। এই বাড়িতেই নজরুল তার বিখ্যাত মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকা উপন্যাস লিখেছিলেন সওগাতে থাকাকালীন সময়ে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের চাপে। কেবল নজরুলই নয়, তাদের বাড়িতে আসতেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহীম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, হবীবউল্লাহ বাহার, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনের মতো কবি সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিকেরাও। মাঝে মাঝে আসতেন বেগম রোকেয়াও।
সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন নূরজাহান। তখন সেখানে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও আরবি ভাষায় পড়ানো হতো। কিন্তু ওখানে পড়াশোনার অসম্ভব চাপ বলে তার বাবা তাকে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে ভর্তি করলেন বেলতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওখানে দুই বছর পড়েছিলেন নূরজাহান। সেখান থেকে পুনরায় আগের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এখানেই পড়েছিলেন তিনি। তখন স্কুলটা ছিল ১৭ নং লর্ড সিনহা রোডের তিনতলা বাড়িতে। এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি নানা সহশিক্ষা, বিনোদন, শিক্ষামূলক কার্যক্রমের ব্যবস্থা ছিল। তাইতো এখানে পড়াকালীন নূরী গান, নাটক, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে সেলাই, খেলাধুলা সমস্ত কিছুতেই অংশ নিয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত সেখানে ছিল ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন নূরজাহান। সে বছরই কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজ ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন জাহানারা ইমাম, রোকেয়া রহমান কবির, হাজেরা মাহমুদ, বিজলি নাগের মতো পরবর্তীকালের বিখ্যাত মানুষেরা। উচ্চ মাধ্যমিকে থাকা অবস্থান নূরজাহান বেগমের ঐচ্ছিক বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল। ১৯৪৪ সালে প্রথম বিভাগে লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় নূরজাহান বেগম। আবার একই বছর একই কলেজেই বিএ'তে ভর্তি হয়েছিলেন নূরজাহান বেগম। বিএ' তে পড়া অবস্থাতেই তার বাবার হাত ধরে জন্ম হলো বাংলা ভাষায় প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক বেগমের। ১৯৪৭ সালে ‘বেগম' এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। তিনিই ছিলেন প্রধান সম্পাদক। ‘বেগম’ পত্রিকা প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিলো ৫০০ কপি। আর এর মূল্য ধরা হয়েছিল চার আনা। প্রথম সংখ্যায় প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল নারী অধিকার পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার ছবি। প্রথম চার মাস বেগমের সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। নূরজাহান বেগমের মতো যারা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ও লেডি বেবোর্ন কলেজে পড়তেন তারা সবাই মিলে বেগম পত্রিকার জন্য কাজ করতেন। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
বেগম পত্রিকার ১২নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়ির অফিসে বসে কাজ করতেন নূরজাহান বেগম। তিনি লেখা সংগ্রহ করতেন, সম্পাদনা করতেন। পাশাপাশি তার বাবার পরামর্শমতো বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ইংরেজি ভাষার লেখা থেকে বাংলায় অনুবাদ করতেন। সুফিয়া কামাল ছাড়াও বেগমে কাজ করতেন মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। একদিকে অনুবাদ, একদিকে মৌলিক লেখা, নারী লেখকদের থেকে লেখা সংগ্রহ, কোন ছবি যাবে, কোন লেখা কীভাবে যাবে বাবার পরামর্শে প্রথম দিকে প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কেটেছিল নূরজাহান বেগমের। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে একদিকে বেগম নাম, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তখন এমনভাবে ছড়িয়েছিল যে এ কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বী লেখিকারা লেখা দিতে চাইতেন না। অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন নূরজাহান বেগম। সুতরাং পত্রিকা চালাতে প্রচুর ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল নূরজাহান বেগমকে। এর মধ্যে সুফিয়া কামাল ঢাকা চলে গেলেন কলকাতা ছেড়ে। তখন পূর্ণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন নূরজাহান বেগম। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় বেগমের প্রথম 'ঈদসংখ্যা বেগম' প্রকাশিত হয়েছিল। এ সংখ্যায় ৬২ জন নারী লেখকের লেখা ছাপা হয়েছিল। এই সংখ্যায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল ৬২টি।
তখন এই পত্রিকায় সুচারুভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করেছিলেন নূরজাহান বেগম। তখন বাবাকে কবি মোতাহেরা বানুর দুই মেয়ে তাহমিনা বানু ও নাসিমা বানুকে "বেগম" পত্রিকায় কাজ করার জন্য নেয়ার পরামর্শ দিলেন নূরজাহান বেগম। তাদের দুজনকে ডেকে পাঠানোর আরেকটি কারণ হলো তাদের তখন অখণ্ড অবসর। পড়াশোনা শেষ। তারা বেগম পত্রিকায় যোগ দেয়ার কারণে নূরজাহান বেগমের ঝক্কি ও চাপ কমলো।
কিন্তু চরম অস্থিরতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে মুহূর্তে ১৯৫০ সালে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসার কথা ভাবছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও তার পরিবার। কিন্তু কোথাও এক জায়গায় প্রেস ও বাড়ি নেই। আছে যেগুলো কারো প্রেস আছে তো কারো বাড়ি আছে, দুটো এক সাথে নেই। শেষমেশ খবর পাওয়া গেল ঢাকার ৬৬ নং লয়াল স্ট্রিট পাটুয়াটুলিতে বিজয় চন্দ্র বসুর বিজয়া প্রেস। কিন্তু তাও একসঙ্গে প্রেস আর বাড়ি নয়। প্রেস ৬৬ লয়াল স্ট্রিটে আর বাড়ি ৩৮ নম্বর শরৎগুপ্ত রোডে। তাই চলে আসার দৃঢ় সিদ্ধান্ত অবশেষে নিয়েই নিলেন তিনি। কলকাতায় চেনা পরিচিরতা, সাহিত্যিকেরা অবশ্য বলেছিলো থেকে যেতে, অচেনা শহরে গিয়ে কি হবে, তারচেয়ে এখানেই তো ভালো। কিন্তু দেশের অবস্থা ভয়াবহ। কে কোন দিন মেরে রেখে যায় কে জানে। নূরজাহান বেগমেরও কলকাতা ছেড়ে আসতে প্রচণ্ড কষ্ট হলো। চারপাশে সব পরিচিত মানুষেরা, সহপাঠী, বন্ধু বান্ধবে ভর্তি। এতো পরিচিত মুখ, এদিকে বেগম পত্রিকা তখন বেশ জমে উঠেছে। ঢাকায় অচেনা পরিবেশ ওখানে গিয়ে কী হবে! ওখানে কেইবা চিনবে। কিন্তু নাসিরউদ্দীন অনড়। এই সুযোগ পাওয়া যাবে না আর। আর এখন তো দুই দেশ হয়েই গেছে। থাকার আর কোনো মানে হয় না। চারপাশে যে অস্থিরতা থাকার কথা কল্পনাও করা যায় না। শেষমেশ বিজয় চন্দ্র বসুর সঙ্গে বাড়ি ও প্রেস অদলবদল করলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। লয়াল স্ট্রিটের বাড়িটা ছিল তখন বুড়িগঙ্গার অনেকটাই কাছে, কলকাতার মতো এখানে বিদ্যুৎ নেই ঠিক কিন্তু বুড়িগঙ্গার দিক থেকে অবাধ হাওয়া। সওগাতের সঙ্গে একই প্রেসে ছাপা হতো বেগমও। তবে নূরজাহান বেগম কাজ করতেন তাদের শরৎগুপ্ত রোডের বাড়িতে বসেই। ওখানে আয়োজন করা হয়েছিলো বেগম এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। সেই অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, পত্রিকার সম্পাদকসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু তখনো ঢাকায় বেগম পত্রিকায় লেখা পাঠানো মেয়ের সংখ্যা হাতে গোনাই ছিল। এসময় ঈদ এগিয়ে আসায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ঈদ সংখ্যা বের করার কথা বলেন। ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ায় বলা চলে আলোড়ন সৃষ্টি করলো বেগম। এরপর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন মেয়েকে নিয়ে যেতেন প্রথিতযশা বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে। যেন নূরজাহান বেগমের কাজ করতে এবং চিনতে সুবিধা হয়, এবং নূরজাহান বেগমও যেন সাগ্রহে তাদের সঙ্গে মিশতে পারে, বেগম এর জন্য লেখা সংগ্রহ করতে পারে। সঙ্গে বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ছিলেন সর্বমহলে পরিচিত। তাই বিজ্ঞাপন পেতে লাগলো বেগম।
১৯৫২ সালে নূরজাহান বেগমের বিয়ে হলো শিশু সওগাতের সম্পাদক প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক, সংগঠক রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে। সে বছরই রোকনুজ্জামান খান যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক মিল্লাতের কিশোর দুনিয়ার শিশু বিভাগের পরিচালক হিসেবে। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মতো স্বামী রোকনুজ্জামান খানও দারুণভাবে সাহায্য করেছিলো তাকে। ধীরে ধীরে বহু প্রতিকূলতার মাঝেও এগিয়ে গেল বেগম। প্রথম দিকে লেখা ও লেখকের সংকট থাকলেও বেগমের কারণে নারী ও মেয়েদের মধ্যে লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হলো। বেগম হয়ে উঠলো নারী স্বাধীনতা, নারী মত ও নারীদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো সওগাত পত্রিকা ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকলে বেগম পত্রিকা একবারও বন্ধ হয়নি তখন। ১৯৫৪ সালে বেগম পত্রিকাকে ভিত্তি করে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও নূরজাহান বেগম গড়লেন বেগম ক্লাব। এটিই বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ক্লাব। বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর সভাপতি হয়েছিলেন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ আর সাধারণ সম্পাদক নূরজাহান বেগম। কবি সুফিয়া কামালকে করা হয়েছিলেন অন্যতম উপদেষ্টা।
এই ক্লাবই নারী লেখকদের একত্রিত ও সংযুক্ত করতে সহযোগিতা করলো। তারা একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করতেন। প্রথম দিকে মাসে একবার। পরের দিকে বছরে একবার। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল বেগম ক্লাব। একসময় বেগম ক্লাব থেকে বিশিষ্ট লেখিকাদের সংবর্ধনা দেওয়া শুরু করল বেগম ক্লাব। প্রথম সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল কবি সুফিয়া কামালকে।
বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে দিনে দিনে নূর জাহান বেগম তুলে এনেছিলেন নারী মত, নারীর নিজস্ব কথন, নারীকে আত্মসচেতন করেছেন তার অধিকার, নিজের আত্মস্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার বিষয়ে। বাঙালি নারীকে উদ্বুব্ধ করেছেন নিজস্ব চিন্তা ভাবনা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়ে। বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে নূরজাহান বেগম নারী জাগরণ ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
২০১৬ সালের ২৩ মে আমরা হারিয়েছিলাম কিংবদন্তী নূরজাহান বেগমকে। গতকাল ছিল বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত, নারী স্বাধীনতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগমের প্রয়াণ দিবস। অসামান্য সৃষ্টি ও চিন্তাশীল এই মহীরুহকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি।
তথ্যসূত্র-
বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ/ পাক্ষিক পত্রিকা "মাকু", প্রকাশিত - ৫ অক্টোবর ১৯৯৭
তোমারি কথা বলবো/ রায়হানা হোসেন- কাজী মদিনা
'বেগম'- এর নূরজাহান/ নূরজাহান বেগমের সাক্ষাৎকার- সুমনা শারমিন
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments