হাফিজুরের মৃত্যু: পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের
বন্ধুদের সঙ্গে ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ঈদের পর দিন ক্যাম্পাসে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান৷ ওই দিন রাতে কার্জন হল এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিলেন হাফিজুর৷ ছোট ভাইয়ের ঢাকায় আসার কারণ সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন হাফিজুরের বড় ভাই হাবিবুর রহমান৷
সাত দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মরদেহ পাওয়া যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে। হাফিজুরের বড় ভাই হাবিবুর রহমান মর্গে গিয়ে তার মরদেহ শনাক্ত করেন।
শাহবাগ থানা পুলিশ বলছে, শহীদ মিনার এলাকায় হাফিজুরকে রক্তাক্ত অবস্থায় পেলেও নাম পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেননি। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়৷ সেখানে কয়েক ঘণ্টা পরই হাফিজের মৃত্যু হয়৷ পরে তার মরদেহ মর্গে অজ্ঞাতনামা লাশের সঙ্গে রাখা হয়৷
হাফিজুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন উর রশীদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, হাফিজ রাস্তার পাশে ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজেই নিজের গলায় আঘাত করে রক্তাক্ত অবস্থায় শহীদ মিনার এলাকায় ঘুরছে- এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠান তিনি৷ এরপর পুলিশ হাফিজুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়৷ পুলিশ হাফিজুরের পরিচয় জানতে পারেনি৷ পরে তার লাশ অজ্ঞাত হিসেবে মর্গে রাখা হয়৷ এ ঘটনায় শাহবাগ থানার পুলিশ অপমৃত্যুর একটি মামলা করেছে।
হাফিজুরের সুরতহাল রিপোর্টে যা আছে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাফিজুরের সুরতহাল সম্পন্ন হয়৷ সে রিপোর্টে উল্লেখ আছে, হাফিজুরের মৃত্যু ধারালো অস্ত্র দ্বারা কাটা জখমের কারণে হয়েছে৷ এছাড়াও ডান হাতের বাহুর নিচে পাশাপাশি দুটি জখম এবং পেটের নিচে একটি জখম রয়েছে৷ ডান হাতের কনুইতে এবং বাম পায়ের হাঁটুতে এবং হাঁটুর নিচে জখম আছে৷
হাফিজুরের সুরাতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করেছেন শাহবাগ থানার এসআই আব্বাছ আলী৷
আত্মহত্যা মানতে নারাজ সহপাঠীরা, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
হাফিজুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও শিক্ষার্থীরা তার আত্মহত্যার ঘটনা মেনে নিতে রাজি নন৷ পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তাদের। এ ঘটনায় হাফিজুরের সঙ্গে যে তিন জন বন্ধু কার্জন হলের আড্ডায় ছিল তাদের জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানিয়েছে তারা।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজু ভাস্কর্যের সামনে "হাফিজ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার চাই" ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়৷ কর্মসূচির আয়োজন করে হাফিজুরের সেশনের শিক্ষার্থীরা৷
এছাড়া আরও তিনটি দাবি জানান তারা। এগুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা, হাফিজুরের লাশ নিয়ে পুলিশ সদস্য ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের দায়িত্বের অবহেলার জবাব দিতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ক্যাম্পাসের আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ৬/৭ দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাফিজের সহপাঠী, বন্ধুরা বারবার জিডি করতে গেলে শাহবাগ থানা কেনো জিডি নেয়নি। অথবা কেনো হাফিজের মৃত্যুর খবরটি জিডি করতে যাওয়াদের জানানো হয়নি? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এত বড় ঘটনা ঘটল হাফিজের বর্ণনা পাওয়ার পরও কেন শাহবাগ থানা জানায়নি একই বর্ণনার একটি ছেলেকে তারা একই তারিখে ডিএমসির মর্গে রেখে এসেছে।'
মানববন্ধন ও সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, 'হাফিজুর রহমানের প্রতি যেন ন্যায় বিচার করা হয়, তার মৃত্যুর যেন সুষ্ঠু তদন্ত করা হয় এবং এই ঘটনার পূর্বাপর কী ঘটেছে তা যেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সামনে উন্মোচন করা হয়। হাফিজুর নিখোঁজ হওয়ার পর শাহবাগ থানায় অবহিত করা হয়। কিন্তু তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় যে লাশ পাওয়া গেছে তা যে হাফিজুরের হতে পারে তা মিলিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। দুঃখের সাথে বলতে চাই, যে ঘটনাটি ঘটেছে তাতে দায়িত্বশীল বাহিনী পেশাদারত্বের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কী ঘটেছিল এবং কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যা বা হত্যার ঘটনা ঘটেছিল তদন্তের ভিত্তিতে তা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সামনে পরিষ্কার করতে হবে। কেউ যদি পেশাদার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাদের বিরুদ্ধে যেন বিভাগীয় শাস্তি গ্রহণ করা হয়।
মাইম অ্যাকশনের সভাপতি লিজাইনুল ইসলাম রিপন বলেন, 'হাফিজ মাইম অ্যাকশনের হয়ে আত্মহত্যার বিপক্ষে প্রতিবাদ করেছে, এমন একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করতে যাবে? আমাদের কাছে এটা কখনো আত্মহত্যা হতে পারে না। তাই অনুরোধ সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক।
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি
হাফিজুরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে শহীদ মিনার এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার দাবি করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃবৃন্দ৷ সোমবার সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি সালমান সিদ্দিকী এবং সাধারণ সম্পাদক প্রগতি বর্মন তমার এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়৷
এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান এক বিবৃতিতে হাফিজুরের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে জমা দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান৷ তিনি হাফিজুরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন৷
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে ঘটনাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তদন্ত করে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ তদন্তের কাজ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ঈদের পর দিন ক্যাম্পাস ফাঁকা ছিল৷ শহীদ মিনার এলাকায় এতো বড় ঘটনা ঘটে গেল৷ প্রক্টোরিয়াল টিম সেটি সম্পর্কে অবহিত ছিল না৷ শুধু পুলিশ অবহিত ছিল৷'
তদন্তের স্বার্থে পুলিশকে সব ধরনের তথ্য প্রমাণ দিতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
হাফিজুরের মৃত্যুর ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে সহকারী প্রক্টর লিটন কুমার সাহাকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। লিটন কুমার সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে আজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শুরু থেকে তদন্ত চলছে
পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন অর রশীদের কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানায় একটি জিডি হওয়ায় শাহবাগ থানায় হাফিজুরের নিখোঁজের ঘটনায় কোনো জিডি নেওয়া হয়নি৷ কারণ ইতোমধ্যে একটি জিডি নেওয়া হয়ে গেছে৷
তিনি আরও বলেন, 'হাফিজুরের সঙ্গে কোনো আইডি কার্ড, ম্যানিব্যাগ কিছু ছিল না৷ যে কারণে আমরা তার পরিচয় জানতে পারিনি৷ অজ্ঞাত লাশ হিসেবে তাকে মর্গে রাখা হয়েছে৷ হাফিজুর নিখোঁজ হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের জানায়৷ তখন আমরা সারা দেশে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছি৷'
শাহবাগ থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন্স) আরিফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে আজ জানান, 'যেদিন ঘটনা ঘটেছে সেদিন থেকে আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে৷ আমরা তদন্তের স্বার্থে কোনো তথ্য প্রকাশ করছি না৷ ময়নাতদন্তের পর হত্যা না আত্মহত্যা সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে৷'
তিনি বলেন, ‘হাফিজুর কী উদ্দেশ্যে ঈদের পর দিনই বাড়ি থেকে ঢাকা এসেছে, এ তথ্যসহ সব তথ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি৷'
গত ১৫ মে থেকে নিখোঁজ ছিলেন হাফিজুর৷ এরপর তার পরিবার কসবা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন৷ গতকাল রবিবার হাফিজুরের বড় ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা অজ্ঞাত লাশের মধ্যে থেকে তার ছোট ভাইয়ের মরদেহ শনাক্ত করেন৷
হাফিজুরের পরিবার তার মৃত্যু নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায়। কাউকে অভিযুক্ত করে মামলা করবে কিনা, সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি৷
হাফিজুরের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে হতাশা ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তার বড় ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, 'হতাশা দেখিনি৷ আনন্দের সঙ্গে ঈদ করেছে৷'
সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাতে নিজ বাড়িতে হাফিজের দাফন সম্পন্ন হয়েছে বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে৷
আরও পড়ুন-
Comments