রেলওয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি: মহামারির ওপর দায় চাপাচ্ছেন মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা
রেল সেবার উন্নয়নের লক্ষ্যে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের সময়সীমা ঢালাওভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে নিজেদের দায় এড়িয়ে করোনা মহামারিকে দায়ী করছে রেল কর্তৃপক্ষ।
গতকাল রোববার এক অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, 'দেরি হওয়ার পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে। কিন্তু, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমি মাঠ পর্যায়ে সফর করেছি। সব প্রকল্প ঠিক সময়ে শেষ করার চেষ্টা করেছি।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।'
রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা এবং বাংলাদেশে রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারও একই কথা বলেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান ৩৯টি প্রকল্পের প্রায় অর্ধেকের মেয়াদ চলতি অর্থবছরের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও, বাস্তবায়ন পদ্ধতির দুর্বলতার কারণে নির্ধারিত সময়ে এগুলোর কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। ফলে প্রকল্পগুলো সংশোধন করে সময়সীমা বাড়াতে হবে।
আর এতে সংকটাপন্ন রেলওয়ে সেবার উন্নয়নের লক্ষ্যে হাতে নেওয়া অনেক প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাবে।
একটি লুপ লাইনসহ ফরিদপুরের মধুখালি থেকে মাগুরা পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তিতে সইয়ের পর মন্ত্রী ও অন্যান্য ঊর্ধতন কর্মকর্তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
এক হাজার ২০২ দশমিক ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মে থেকে আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, অপ্রত্যাশিত বাধার কারণে অবশেষে অনুমোদন পাওয়ার তিন বছর পর এর কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গতকাল এই প্রকল্পটি নিয়ে চীন-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগের দুটি কোম্পানির সঙ্গে ১৮ মাসের এক চুক্তি সই করেছে। অর্থাৎ, কর্তৃপক্ষকে এখন এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা বাড়াতে হবে।
প্রকল্পটি শুরু করতে এতো বেশি দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, 'এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণা ছাড়া এবং নকশা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি এটির অনুমোদন দিয়ে দেয়।'
এ ছাড়া, জমি কিনতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগা এবং সর্বোপরি, মহামারির কারণে এ দেরির পেছনে দায়ী বলে উল্লেখ করেন রেলমন্ত্রী। প্রকল্পটির মেয়াদও বাড়বে বলে জানান তিনি।
নাম গোপন রাখার শর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত অনুমোদনের আগেই একটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণা করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে গবেষণা করা হয়েছে প্রকল্প অনুমোদনের পরে। গবেষণা শেষ হতে দেড় বছর সময় লেগেছে।'
বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে এক লাখ ৪১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার ৩৯টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে, যার বেশিরভাগেরই অর্থ আসছে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ থেকে।
রেলওয়ের নথি অনুযযায়ী, চলতি বছরের জুনে ২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হবে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর মধ্যে মাত্র চারটির কাজ জুনে শেষ হতে পারে এবং একটি প্রকল্প বাতিল হয়ে যেতে পারে।
প্রকল্পের নথি যাচাই করতে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, ২৪টির মধ্যে ১৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ইতোমধ্যেই এক বা একাধিকবার সংশোধিত হয়েছে।
কেনো এতোবার প্রকল্পের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দেননি মন্ত্রী।
এ মহামারির মধ্যেও কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে সাধুবাদ জানানো উচিত বলে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'এখন বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে এবং চীন ও ভারতের প্রকৌশলীরা বিভিন্ন প্রকল্পে জড়িত আছেন। তাদের অনেকেই মহামারির কারণে বাংলাদেশে আসতে না পারায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে।'
মন্ত্রী আরও দাবি করেন, সব প্রকল্পের ব্যয় মেয়াদ বাড়ানোর জন্য বাড়েনি। বরং কাজের পরিধিতে পরিবর্তন আসায় বেড়েছে।
রেলওয়ে সচিব সেলিম রেজা বলেন, 'বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নতুন কোন ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যু না করা এমনই একটি সিদ্ধান্ত।'
মহামারিতে খরচ কমিয়ে রাখার সিদ্ধান্তে অটল থাকার কারণে, গত সপ্তাহে সরকার স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য সব মন্ত্রণালয়কে বর্তমান অর্থবছরের বাকি সময়টুকুতে আর নতুন কোন ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যু না করার নির্দেশ দিয়েছে।
'তবে এটিকে (এক হাজার ২০২ দশমিক ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্প) এই নির্দেশের বাইরে রাখা হয়েছে। আপনাদেরকে পরিস্থিতি বুঝতে হবে। মহামারির মধ্যেও কিন্তু প্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত আছে', সেলিম রেজা বলেন।
তিনি জানান, তাদের এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
ধীরেন্দ্র দাবি করেন, মেয়াদ বাড়লে রেলওয়ে প্রকল্পের খরচ বাড়ে না, কাজের পরিধি পরিবর্তিত হলে বাড়ে।
চুক্তি
এই প্রকল্পের কাজ দুটি প্যাকেজের আওতায় সম্পন্ন হবে—একটি রেল পথের জন্য এবং আরেকটি রেল সেতুর জন্য ।
চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের ক্যাসল কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগের একটি কোম্পানি ৪৩৩ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথম প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করবে।
চায়না রেলওয়ে কন্সট্রাকশন কর্পোরেশন লিমিটেড ও বাংলাদেশের মীর আখতার হোসেন লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগের আরেকটি কোম্পানি ৪৪৮ দশমিক ৯৮ কোটি টাকার দ্বিতীয় প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করবে।
ক্যাসল কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মূল প্রতিষ্ঠান জেমকম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ এবং মাগুরা-১ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামীলীগের আরেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরসহ অন্যান্যরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন প্রকল্প পরিচালক আসাদুল হক।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments