সংবেদনশীলতার এতটা ঘাটতি কেন

ফরিদ আহম্মেদ খান (বামে) এবং তার সঙ্গে কথা বলছেন ইউএনও আরিফা জহুরা (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার পশ্চিম দেওভোগ এলাকার সত্তরোর্ধ্ব হোসিয়ারী শ্রমিক ফরিদ আহম্মেদ খান। কিন্তু চার তলা বাড়ির মালিক হওয়ার কথা বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাকেই উল্টো ১০০ জনকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সাজা দিয়েছেন।

তবে বাস্তবে ফরিদকে কোনোভাবেই সেই বাড়ির মালিক বলা যায় না। ছাদে দুটি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তিনি। বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটে তার পাঁচ ভাই ও এক বোন বসবাস করেন। ফরিদ হোসিয়ারী কারখানায় কাজ করে মাসে সাকুল্যে ১০ হাজার টাকা আয় করেন। স্ত্রী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে ও কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। মেয়ের গয়না বন্ধক রেখে ও ঋণ করে শনিবার ইউএনওর উপস্থিতিতে জরিমানার খাদ্য বিতরণ করেছেন ফরিদ।

ইউএনও আরিফা জহুরা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তিনি ৩৩৩ নাম্বারে ফোন করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন। ২০ মে বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায় তিনি নিজেই একটি চারতলা বাড়ির মালিক। বিভ্রান্ত করায় তাকেই ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা দিতে বলা হয়। প্রতি প্যাকেট ছিল ১০ কেজি চাল, পাঁচ কেজি আলু, এক কেজি করে ডাল, সয়াবিন তেল, লবণ ও পেঁয়াজ।’

ফরিদের অসহায়ত্বের কথা গণমাধ্যমে আসার প্রসঙ্গে ইউএনও বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি যদি সত্যিই অসহায় হয়ে থাকেন তাহলে তিনি যে টাকার ত্রাণ দিয়েছেন সেই টাকা উপজেলার ত্রাণ তাহবিল থেকে ফেরত দেওয়া হবে।’

ফরিদ আহম্মেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘খবরে শুনেছিলাম ৩৩৩ নাম্বারে ফোন দিলে সরকারি খাদ্য সহায়তা পাওয়া যাবে। এ কারণে আমি ফোন দিয়েছিলাম। তারা আমার নাম-ঠিকানা নেয়। পরদিন স্থানীয় কাশিপুর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার ও প্যানেল চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী ফোন দিয়ে বলেন আপনি বাড়ির মালিক আপনার জন্য এ সহায়তা না। আপনি কেন ত্রাণ চাইলেন? এর জন্য আপনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ক্ষমা চাইবেন। এর দুই দিন পর ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ এলে মেম্বারের কথা অনুযায়ী ক্ষমা চাই। তিনি ক্ষমা না করে ১০০ জনের মধ্যে খাবার বিতরনের জরিমানা করেন। অন্যথায় তিন মাসের জেলের কথা বলেন। সেজন্য আমি খাবার বিতরণ করি।’

কেন খাদ্য সহায়তা চেয়ে ছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বাড়ির মালিকদের একজন এটা সত্য। এই চার তলা ভবনের দুই রুমের ফ্ল্যাটে আমি স্ত্রী, এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে ও কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বসবাস করি। এটুকুরই মালিক আমি। বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটে আমার আরও পাঁচ ভাই ও এক বোন পরিবার নিয়ে থাকেন। এ বাড়িতে কোনো ভাড়াটিয়া নেই। আমি হোসিয়ারীতে কাজ করি। সব মিলিয়ে মাসে আয় মোট ১০ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে মেয়ের পড়ালেখা, প্রতিবন্ধী ছেলের ওষুধ, নিজের ওষুধ ও সংসার খরচ চলে না। খুব কষ্ট করে জীবনযাপন করছি। এর মধ্যে লকডাউনের শুরুতে চার মাসের বেতন দেয়নি মালিক। তখন ঋণ করে চলেছি। সেই ঋণ এখনও পরিশোধ করতে পারিনি। এখনও লকডাউনে কারখানা মালিক ঠিক মতো বেতন দিতে পারছে না। খুব কষ্টে সংসার চলাচ্ছি। যেহেতু সরকার সহায়তা দিচ্ছে তাই ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাবার চেয়েছি।’

ফরিদ আহম্মেদ খানের স্ত্রী হিরন বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সবাই বলেছে মোবাইল কোর্টের জরিমানা না দিলে স্বামীর তিন মাসের জেল হয়ে যাবে। আমি আইয়ুব আলী মেম্বারের কাছে গেছি, যাতে জরিমানা কমিয়ে দেয়। মেম্বার বলল, ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনকে দিলেও হবে না। এমনিতেই স্বামী অসুস্থ। এ বয়সে জেলে গেলে মরে যাবে। তাই মেয়ের গলার চেইন বন্ধক দিয়ে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। আত্মীয়-স্বজন, পরিচতদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খাবার বিতরণ করেছি।’

এই কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

ফরিদ আহম্মেদ খানের বড় ভাই লুৎফর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার ভাই এমনিতেই অসুস্থ। সে বুঝিয়ে বলতে পারেনি যে পুরো বাড়ির মালিক সে না। তিন শতাংশ জমির উপর চার তলা বাড়ির মালিক আমরা ছয় ভাই ও এক বোন। হিসাবে ফরিদ শুধু দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটের মালিক। থাকার জায়গা নেই তাই সে ছাদে ওপর দুটি ঘর তুলে থাকছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সব ভাই হোসিয়ারী শ্রমিক। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে কষ্ট করে সংসার চলে। শুধু বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না বলেই সামান্য আয় দিয়ে চলতে পারছি। আমার ভাইয়ের এক মেয়ের বিয়ে বাকি, ছেলে প্রতিবন্ধী, সে নিজেও অসুস্থ। তার ত্রাণ প্রয়োজন ছিল। ইউএনও ম্যাডাম ভালো ভাবে খোঁজ নিলে এ ভুল হতো না।’

সরেজমিনে দেখা যায়, ‘পুরানো তিন তলা ভবনের ছাদের ওপর ঘর তোলায় বাড়িটিকে চার তলা বলা যেতে পারে। বাইরে পলেস্তারা থাকলেও রঙ করা হয়নি। ভেতরের দেয়াল ও সিঁড়িতে পলেস্তারা নেই। বাড়ির ছাদে দুটি ঘরে এক মেয়ে, প্রতিবন্ধী ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন ফরিদ।

প্রতিবেশি চায়ের দোকানদার আইয়ুব আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যিনি নিজেই ঋণ করে সংসার চালান তিনিই আজ ত্রাণ দিয়েছেন। অথচ তার জন্যই ত্রাণ দরকার ছিল। ইউএনও আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। আর পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট দেখে আমরাও নিজেরা এগিয়ে গিয়ে কিছু বলিনি। আমাদের জিজ্ঞাসা করলেই ফরিদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারত। ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করলে এমনটা হতো না।’

ফরিদ যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সেই ‘আবুল গার্মেন্টস’ নামের হোসিয়ারী কারখানার পরিচালক মাসুদ রানা কলি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ফরিদ গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমার কারখানায় কাজ করেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় চোখে ঠিক মতো দেখেন না। আগের মতো কাজও করতে পারেন না। এ কারণে তিন বছর আগেই তাকে কাজে আসতে মানা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তার অসহায়ত্বের কথা শুনে কাজে রেখেছি। কারখানায় চা-নাস্তা আনা, মালামাল বুঝে নেওয়ার মতো সহজ কাজগুলো তিনি করেন। এজন্য ছয় হাজার টাকা বেতন দেই। কাটিং করতে পারেন বলে অন্য কারখানায় কাজ করে আরও কিছু টাকা পান।’

এদিকে কাশিপুর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার ও প্যানেল চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিয়েও তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ওই ব্যক্তি তার অসহায়ত্বের কথা বুঝিয়ে বলতে পারেননি। আজকের মধ্যে ত্রাণের টাকা পরিশোধ করতে ইউএনওকে বলা হয়েছে। আশা করছি রাতের মধ্যে টাকা পেয়ে যাবেন।’

Comments

The Daily Star  | English

10 ministries brace for budget cuts

The railway ministry, the power division, and the primary and mass education ministry will see the biggest chop.

9h ago