সহায়তা পেলেন না, অপমান অসম্মানে ঘরবন্দী ফরিদ আহম্মেদ

‘টাকা পাইছি, সহায়তা পাইনি। যে ঋণ করছিলাম ওইগুলা পরিশোধ করা হইছে। এখন আরও টেনশন যেন বাইড়া গেছেগা। মানসম্মান শেষ। কিছুক্ষণ আগে আমার শালী ফোন করছে, আমার পরিবার অনেক কান্না করছে। কেমনে মুখ দেখামু, বাইরে যাই মানুষ হাসাহাসি করে, মানুষ তাকায় থাকে যে, এটা কি হইল তোর। কি করতে গিয়ে কি করলি। এসময় আমি বিছানায় থাকার কথা না। আমি বাইরে গিয়ে হাঁটাচলাও করতে পারি কিন্তু আমার ইচ্ছা করে না।’
ফরিদ আহম্মেদ খান। ছবি: স্টার

‘টাকা পাইছি, সহায়তা পাইনি। যে ঋণ করছিলাম ওইগুলা পরিশোধ করা হইছে। এখন আরও টেনশন যেন বাইড়া গেছেগা। মানসম্মান শেষ। কিছুক্ষণ আগে আমার শালী ফোন করছে, আমার পরিবার অনেক কান্না করছে। কেমনে মুখ দেখামু, বাইরে যাই মানুষ হাসাহাসি করে, মানুষ তাকায় থাকে যে, এটা কি হইল তোর। কি করতে গিয়ে কি করলি। এসময় আমি বিছানায় থাকার কথা না। আমি বাইরে গিয়ে হাঁটাচলাও করতে পারি কিন্তু আমার ইচ্ছা করে না।’

মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার পশ্চিম দেওভোগ এলাকার নিজের ঘরে বসে দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলছিলেন ‘৩৩৩’ নম্বরে খাদ্য সাহায্যের জন্য কল দিয়ে উল্টো জরিমানা দেওয়া সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ হোসিয়ারী শ্রমিক ফরিদ আহম্মেদ খান। এখনও কোনো খাদ্য সহায়তা পাননি তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ হওয়ার মতো অবস্থা ফরিদের ঘরে। দারিদ্র্য ফরিদকে গ্রাস করলেও কাউকে বুঝতে দেননি। দুই রুমের ঘরের সব কিছুই সাজানো-গোছানো। মহামারি শুরুর আগে তার সংসার মোটামুটি ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু করোনার দুঃস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে খাদ্য সহায়তা চেয়ে ‘৩৩৩’ এ কল করেছিলেন ফরিদ। কিন্তু সেটা যে বুমেরাং হবে তা আগে কল্পনাও করেননি। এখন অপমানে ঘরবন্দী হয়ে আছেন তিনি।

বাড়িওয়ালা হয়ে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সহায়তা চাওয়ায় হোসিয়ারী কারখানার শ্রমিক ফরিদ আহম্মেদ খানের জরিমানার ত্রাণ সামগ্রী ১০০ জনের মধ্যে বিতরণ করেন সদর উপজেলার ইউএনও আরিফা জহুরাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ছবি: স্টার

রোডিওতে শুনে গত ১৮ মে ‘৩৩৩’ এ কল দিয়ে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন ফরিদ। দুইদিন পর সরেজমিনে বাড়ির সামনে আসেন সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরা। ভালোমতো যাচাই না করেই তিনি ধরে নেন, ফরিদ ৪ তলা বাড়ির মালিক এবং তার হোসিয়ারী কারখানা আছে। এজন্য সহায়তা না দিয়ে তার উপস্থিতিতে উল্টো ১০০ জনকে খাদ্য সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন। অন্যথায় তিন মাসের জেল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২২ মে বিকেলে ১০০ জনের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণে বাধ্য হন ফরিদ।

ফরিদ আহম্মেদকে বাড়ির মালিক বলা যায় না। তিনি ছাদে দুটি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটে তার পাঁচ ভাই ও এক বোন বসবাস করেন। ফরিদ হোসিয়ারী কারখানায় কাজ করে মাসে সাকুল্যে ১০ হাজার টাকা আয় করেন। স্ত্রী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে ও কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

এই টাকা সংগ্রহ করতে ঋণের পাশাপাশি বন্ধক রাখেন মেয়ের সোনার গয়না। পরে এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে দেশ জুড়ে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। জেলা প্রশাসক ইউএনওকে ত্রাণ তহবিল থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিকে বুধবারের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক।

ফরিদ আহম্মেদ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘জরিমানার টাকা আমি ফেরত পেয়েছি। কিন্তু আমি যেজন্য ‘৩৩৩’ এ কল দিয়েছিলাম সেই সহায়তা পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘এলাকার একজন ব্যবসায়ী শাহিনুর আলম ডেকে নিয়ে আমাকে টাকা দিয়েছে। উনি কেন টাকা দিয়েছেন সেটা জানি না। তবে টাকাটা আমার খুব দরকার ছিল। কারণ মেয়ের গয়না বন্ধক দিয়ে আমি টাকা এনেছিলাম। টাকা ফেরত দিয়ে গয়না এনে মেয়েকে দিয়েছি।’

ঘটনার পর থেকে কাজে যাচ্ছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মান সম্মান শেষ। মনের ভেতর একটা অশান্তি বোধ করছি। এর জন্য আমি লজ্জিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনার পর আত্মীয়-স্বজন কেউ আমার বাড়িতে আসে নাই। আমার আত্মীয়-স্বজনরা ফোনে বলতেছে মানসম্মান সব শেষ। মানসম্মান শেষ হলে আমার কি করার আছে? আমি তো চুরি করি নাই, আমি মার্ডারও করি নাই, ডাকাতিও করি নাই। আমি জানি সরকার আমাদের জন্যই এ সিস্টেম চালু করছে। কিন্তু পরে জানতে পারছি আমাদের জন্য না। তাহলে আমার কিছু করার নাই।’

ঘরে এখন খাবারের অভাব আছে? তিনি বলেন, ‘এখন কিছু খাবার সংগ্রহ হয়েছে। ঢাকা থেকে অনেকেই এসে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। আমি নিতে চাইনি। অনেকেই ফোনে বিকাশ নাম্বার দিতে বলেছে। আমি সবাইকে না করে দিয়েছি। এটা করেই আমি এতো বড় হয়রানির শিকার হলাম। আমার আর টাকা লাগবো না। আমার কারও সহযোগিতা লাগবো না।’

৬০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা ব্যবসায়ী শাহিনুর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় দান করি। পত্রিকায় ফরিদের বিষয়ে জানতে পেরে খোঁজ খবর নেই। সে আসলেই অসহায় তাই সহযোগিতা হিসেবে ৬০ হাজার টাকা দিয়েছি। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভাবে সহযোগিতা করেছি। ইউএনও কিংবা প্রশাসনের কেউ আমাকে কিছু বলেনি।’

তিনি বলেন, ‘ফরিদ সত্যিই অসহায়। প্রশাসনের উচিত তাকে সহযোগিতা করা। তার একটি প্রতিবন্ধী ছেলে ও বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে। এদের মুখের দিকে তাকিয়েও সহযোগিতা করা প্রয়োজন।’

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইউএনও আমাকে জানিয়েছেন একটি চ্যারিটেবল ফান্ড থেকে তাকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে সেই টাকা দেওয়া হয়েছে।’

‘৩৩৩’ নম্বরে ফোনে যে ত্রাণ সহযোগিতা চেয়েছিলেন সেটা এখনও পাননি? জবাবে তিনি বলেন, ‘উনি যে তথ্য দিয়েছেন সে তথ্য সম্পূর্ণ সঠিক না হওয়ায় তাকে ত্রাণ দেওয়া হয়নি। উনি ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য কিনা সেই সন্দেহ থেকে এ ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমাকে ফোন দিলে আমরা উনাকে সহযোগিতা করব। আমরা নিজ উদ্যোগে ত্রাণ পৌঁছে দেবো।’

আরও পড়ুন:

সংবেদনশীলতার এতটা ঘাটতি কেন

Comments

The Daily Star  | English

Banks to freeze accounts of Orion Group chairman, MD, four others

The Bangladesh Financial Intelligence Unit (BFIU) has instructed banks in the country to freeze any accounts owned by Orion Group Chairman Obaidul Karim and its Managing Director Salman Obaidul Karim.

4h ago