সেন্ট মার্টিন এখন প্রবাল লুটেরাদের স্বর্গ
এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই নিষেধাজ্ঞা এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে আরোপ করা বিধিনিষেধের ফলে দ্বীপটিতে প্রশাসনের নজরদারি কমে গেছে। স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও তাদের সহযোগীদের জন্য বিষয়টি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
অন্তত তিন জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি দ্বীপটি থেকে প্রবাল উত্তোলন করে ভাঙছেন এবং কোনো রাখঢাক ছাড়াই সেগুলো হোটেল বা আবকাঠামো নির্মাণকারীদের কাছে বিক্রি করে রমরমা ব্যবসা করছেন।
দ্বীপে ক্রমবর্ধমান আবাসন চাহিদাকে পুঁজি করে এ দুর্বৃত্তরা সেখানে বেআইনিভাবে একতরফা নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যদিও সেন্ট মার্টিনে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা নিষিদ্ধ।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার এ দ্বীপটিকে ১৯৯৯ সালে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই এ নিষেধাজ্ঞা বলবত আছে।
তা সত্ত্বেও, দুর্বৃত্তদের সংঘবদ্ধ চক্রটি মূল ভূখণ্ড থেকে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর চালান নিয়ে আসে এবং একইসঙ্গে দ্বীপ থেকে প্রবাল উত্তোলন করে। প্রবাল উত্তোলন এবং তা ভাঙতে তারা প্রায় ১৫০ জন দ্বীপবাসী শ্রমিককে ব্যবহার করে। প্রতি বর্গফুট ভাঙা প্রবাল তারা শ্রমিকদের থেকে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে কিনে নেয়। পরে এগুলো হোটেল মালিকদের কাছে প্রতি বর্গফুট ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।
মূল ভূখণ্ড থেকে আনা পাথর তারা বিক্রি করে ১৮০ টাকা বর্গফুট দরে। এতে সেন্ট মার্টিনের বিভিন্ন নির্মাণকাজে ‘কম দামের’ ভাঙা প্রবালের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, দ্বীপটিতে প্রায় ২০টি হোটেল এবং রিসোর্ট নির্মাণের কাজ পুরোদমে চলছে। চলমান ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে এ কার্যক্রমে আরও গতি এসেছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা চলাকালেও সেখানে একইভাবে নির্মাণকাজ চলেছে বলে জানান তারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) পরিচালক (পরিকল্পনা) সোলায়মান হায়দার জানান, ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে ইসিএ ঘোষণা করা হয় এবং এবং তখন থেকেই সেখানে কংক্রিটের কোনো অবকাঠামো নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। এরপরও, গত কয়েক বছরে দ্বীপটিতে হোটেল ও রিসোর্টের জন্য ১৫০টিরও বেশি কংক্রিটের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আরও অনেকগুলোর নির্মাণ কাজ চলমান আছে।
এসব অবকাঠামোর মালিকদের কাছ থেকে কখনোই পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো তদারকি বা আইনের প্রয়োগ ছাড়াই এ অবৈধ নির্মাণকাজ চলছে।
দ্বীপের প্রবাল তো ধ্বংস করা হচ্ছেই, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য এখানকার সমুদ্র সৈকতের বালু পর্যন্ত লুট করা হচ্ছে। পর্যটকদের সমুদ্র দেখার সুবিধা করে দিতে গিয়ে হোটেল মালিকরা দ্বীপটিকে ঘিরে থাকা স্ক্রু পাইন বা কেয়ার বনও উজাড় করছেন। অথচ, এই কেয়ার ঝাড় সেন্ট মার্টিনকে সামুদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা করে।
পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম এবং অনুমোদনহীন বালু ভর্তি জিওটেক্সটাইল ব্যাগের ব্যবহার সমুদ্র সৈকতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং এক পর্যায়ে এটি দ্বীপের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার নিষিদ্ধ। পরিবেশগত সংকটে থাকা সেন্ট মার্টিনে তারা এমনকি অ-বাণিজ্যিক কাঠামো নির্মাণ বা মেরামতের জন্যও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের অনুমোদন দিচ্ছেন না। তারপরও, দুর্বৃত্তদের সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে মূল ভূখণ্ড থেকে এসব নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আসছে এবং আরও লাভের আশায় দ্বীপ থেকে প্রবালও উত্তোলন করছে।’
ইউএনও বলেন, দুর্গম দ্বীপটির দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থেকে প্রশাসনের পরিচালনা করা অভিযানে তেমন কোনো ফল পাওয়া যায় না। তবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তারা সেখানে প্রবাল উত্তোলন এবং অবৈধ নির্মাণ কাজ বন্ধের চেষ্টা চালাবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর আহমেদ স্বীকার করেন, দ্বীপে বেশ কয়েকটি হোটেল ও রিসোর্ট নির্মিত হচ্ছে এবং রাজনীতিতে যুক্ত লোকজন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে সেখানে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আসছেন।
তবে, নির্মাণ সামগ্রীর অবৈধ বাণিজ্য ও প্রবাল ধ্বংসে জনপ্রতিনিধিদের জড়িত থাকার বিষয়ে তার জানা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এখানে নির্মাণকাজ যে অবৈধ, তা উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তর বা সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ আমাদের এখনো কোনো চিঠি পাঠায়নি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো লিখিত নির্দেশনাও দেয়নি। তাহলে আমরা কীভাবে ব্যবস্থা নেব?’
সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন পরিদর্শনকালে দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতা দ্বীপটির উত্তর সৈকতের (স্থানীয়ভাবে ডেইল পাড়া নামে পরিচিত) একটি অংশ জুড়ে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ রাখা থাকতে দেখেন। সৈকতকে ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য এসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।
জিও ব্যাগ ও বাংলাদেশ পুলিশের তৈরি একটি রিসোর্টের মাঝামাঝি সৈকতে আরও বেশি ভাঙনের আলামত চোখে পড়ে তার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সোলায়মান হায়দার জানান, একই সৈকত থেকে থেকে বালু নিয়ে জিও ব্যাগ ভরাট করায় সৈকতের ভাঙন আরও বেড়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহমেদ এ ব্যাগগুলো সৈকতে রেখেছেন এবং এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নূর আহমেদ বলেন, ‘পাশের একটি গোরস্থানকে রক্ষা করতে তিনি সৈকতে এসব ব্যাগ রেখেছেন।’
এ ছাড়াও, সেন্ট মার্টিন ঘুরে দেখা গেছে, হোটেলের রুম থেকে পর্যটকদের যেন সমুদ্র দেখতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য সাগরমুখী হোটেলগুলোর সামনের কেয়া বন কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments