দুঃখের ধার ধারেন না রববার মাঝি

Robrar_Lalmonirhat
আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও ধরলা নদীতে নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন রববার আলী। ছবি: স্টার

আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও ধরলা নদীতে জীবনের নৌকা বেয়ে চলেছেন রববার মাঝি। ছেলে-মেয়েদের পৃথক সংসার। বৃদ্ধা বউকে নিয়ে শেষ বয়সে আলাদাই থাকেন। কারো প্রতি অভিযোগ করা কিংবা অভাবে হাত পাতার অভ্যাস নেই। ‍মুখের কোণায় লেগে থাকা এক চিলতে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেন সব। কোনো দুঃখ নেই তার।

এক সময়ের গৃহস্থ রববার মাঝির ১৫ বিঘা জমি চলে গেছে ধরলার গর্ভে। এখন তার নৌকায় চড়ে কেউ পারানির পয়সা দেন, কেউ দেন না। তাতেও তার আফসোস হয় না।

এক সময় পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভূক্ত একটি গল্পের নাম ছিল ‘সুখী মানুষের জামা’। প্রখ্যাত নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ এর একটা নাট্যরূপও দিয়েছিলেন। যার কাহিনী কম-বেশি সবার জানা।

সেই যে, গ্রামের এক মোড়লের ভীষণ অসুখ হলো। বহু চিকিৎসক, বৈদ্য, হেকিম, ওঝা দেখানো হলো। কেউই রোগ সারাতে পারছেন না। অবশেষে একজন চিকিৎসক এসে মোড়লকে ভালোভাবে দেখে বললেন— ‘মোড়লকে সুস্থ করা যাবে। তবে উপায় হলো একজন সত্যিকারের সুখী মানুষের জামা লাগবে। সে জামা গায়ে দিলে মোড়ল সুখী হয়ে সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

অনেক খোঁজার পর একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল। যিনি ছিলেন নিতান্তই সাধারণ। এতই সাধারণ যে তার কোনো জামা ছিল না।

গল্পটির শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে, ধন-সম্পদ অথবা জৌলুশের মধ্যে সুখ নেই। সুখ ব্যক্তি মানসিকতার উপলব্ধির বিষয়। রববার মাঝি যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা সেই সুখী মানুষটি।

সম্প্রতি মাঝির সঙ্গে কথা হয় লালমনিরহাটের সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের চর বিয়ানীবাজার এলাকায়। মুখের হাসি ধরে রেখেই তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মোর কোনো দুখকো নাই, মুই সুখোত আছোং। সারাদিন নৌকা চালাং। যেইকনা কামাই হয় সেইকনা দিয়া চলোং। ভালো আছোং মুই।’

চর বিয়ানীবাজার এলাকাটি সীমান্তঘেঁষা। পাশেই রয়েছে চর ফলিমারী ও চর গোড়কমণ্ডল। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, বিয়ানীবাজার চরে থাকা রববার মাঝির ১৫ বিঘা জমি চলে গেছে ধরলার পেটে। এখন পাঁচ শতাংশ জমিতে ঘর তুলে স্ত্রী মহিরন বেগমকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আলাদা সংসার তাদের।

চর বিয়ানীবাজারের ঘাটে রবরার মাঝির বৈঠাচালিত নৌকায় ধরলা পার হন চর ফলিমারী ও চর গোড়কমণ্ডলের বাসিন্দারা। পারানি হিসেবে প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি পাঁচ টাকা করে নেন। সেটাও অনেকে দেন না। দিনভর নৌকা চালিয়ে যা আয় হয়, তার অর্ধেক দিতে হয় ঘাটের ইজারাদারকে। বেলা শেষে ৮০ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি।

মাঝি বলছিলেন, ‘মোর বুড়ি বউয়ের শরীরটা ভালো যাবার নাইগছে না। দাওয়াই কেনা নাগে ওর জন্য। মাছ-মাংস তো কিনবার সাধ্য নাই। তাই মাঝে মাঝে নদীত মাছ ধরোং।’

রববার মাঝির সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তীব্র অভাবও এই বৃদ্ধের আত্মমর্যাদাকে বিকিয়ে দিতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘যখন মোর জমিগুলা নদীত যায় নাই, তখন মোর কোনো অভাব আছিলো না। অ্যালা অ্যাকনা অভাবত আছোং। তয় মুই কিন্তু কাকো বুঝবার দ্যাং না।’

Robrar1_Lalmonirhat
তার নৌকায় চড়ে কেউ পারানির পয়সা দেন, কেউ দেন না। ছবি: স্টার

হাসি দিয়ে দুঃখ জয় করার মন্ত্রে দীক্ষিত এই বৃদ্ধ মাঝি বলে ওঠেন, ‘ঘরোত বাইরোত সোকসময় মুই হাসোং, মোর বুড়িও হাসে। কান্দি কী হইবে। কাইও তো আর খাবার দিবার নয়। মুখের হাসি কোনা নিয়াই বাঁচি আছোং হামরা।’ 

আমিনুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দাও জানালেন, রববার মাঝিকে তারা কখনো বিষণ্ন মুখে দেখেননি। কারো কাছে তিনি কখনো হাতও পাতেন না।

ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জয়মূল্য চন্দ্র বর্মণ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সহায়-সম্বল না থাকলেও রবরার আলী একজন সুখী মানুষ। স্থানীয়ভাবে কোনো ত্রাণ সহযোগিতা বরাদ্দ এলে তাকে দেই। কিন্তু নিজে থেকে কোনো কিছুর জন্যই আবদার করেন না তিনি।’

এই ইউপি সদস্যের ভাষ্য, সামান্যতেই কীভাবে সুখের জীবন যাপন করা যায়, রববার মাঝি তার একটি বড় উদাহরণ।

Comments

The Daily Star  | English
Banks income from investment in bonds

Bond boom contributes half of bank income

The 50 banks collectively earned Tk 39,958 crore from treasury bonds in 2024, up from Tk 27,626 crore in the previous year, according to an analysis of their audited financial statements.

13h ago