মিয়ানমারে কবি ও কবিতাও রক্তাক্ত
সামরিক অভ্যুত্থানে মিয়ানমারের অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাত হয়েছে। নির্বাচনে তার দল নিরঙ্কুশ জয় পেলেও সামরিক বাহিনী জালিয়াতির অভিযোগ এনে তাকে গৃহবন্দী করে। শত-শত বিক্ষোভকারী এবং বিরোধী নেতাদেরও আটক করে। মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জান্তা সরকার আটক করেছে কবি সাহিত্যিক শিল্পীদেরও।
৩১ জানুয়ারি ২০২১, মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের আগের রাত। খ্যাতিমান কবি ক জে উইন ঘুমিয়ে ছিলেন, কাই জাও আয়ের বাড়িতে। কাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবি। উইনের বন্ধু। দুজনে সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে কাজ করছিলেন। সকালে জানতে পারেন ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলে করেছে। কবি আগেই পরিস্থিতি অনুধাবন করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের সামনে যে যুদ্ধ আসছে, আমাদের তাতে সামিল হতে হবে।’ এবং তারা দুজনেই রাজপথে নেমেছিলেন গণতান্ত্রিক মুক্তির লড়াইয়ে।
অভ্যুত্থানের দুই সপ্তাহ পরে লিখেছিলেন। ‘আমি অন্যায়কে সমর্থন করতে চাই না। আমার যদি বেঁচে থাকার এক মিনিট সময় থাকে তবে আমি চাই যে আমার বিবেকটি এই মিনিটের জন্য পরিষ্কার থাকুক।’ নিহত হওয়ার আগে উইন ফেসবুকে কবিতা লিখতেন। সর্বশেষ লিখেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার দ্বিমত থাকতে পারে, তারপরও তোমার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব।’ উইনের সর্বশেষ ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করেন। শিরোনাম ‘খুলির সম্পর্কে।’
কবিতায় তিনি বলেছিলেন-
বিপ্লব প্রস্ফুটিত হবার আগে
রাজপথে আবক্ষের খুলি থেকে
কি বাণী আসে আমাদের জন্য?
যখন শয়তানেরা মুখোমুখি হয়
তখন তো বিবৃতিও গুরুত্বপূর্ণ?
কিংবা/
দ্বিধাবিভক্ত হয়ো না
বিপ্লবের বিস্ফোরক তবে
ঠিক তুমি কিংবা আমি (অনুবাদ অভিনু কিবরিয়া ইসলাম)
ক জে উইনের বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর। সংবেদনশীল ও বন্ধুবৎসল কবি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন। আর এটাই তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনে করতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন। পরে মুক্তি পান। সাধারণ মানুষের মুক্তির প্রশ্নে নিজেকে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। লিখেছিলেন, ‘তারা গুলি চালায় মাথায়, কিন্তু তারা জানে না, বিপ্লব বাস করে হৃদয়ে’। মুহূর্তে মুখে মুখে চলে যায়। দেশটির শিল্পী সমাজ মনে করে, ক জে উইন একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।
সেদিন ছিল রোববার ৮ মে ২০২১। সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য কেথ থির বাড়িতে আসেন। তারা কোনো ভূমিকা ছাড়াই তাকে বলে, ‘আমাদের সঙ্গে। যেতে হবে তোমাকে’ কেথ অপ্রস্তুত, ‘কোথায় যাব?’ উত্তর দেয় না সৈন্যরা। টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় কবিকে। কেত থি’র স্ত্রী জানান, তাদের দুজনকেই সাগাইং অঞ্চলের কেন্দ্রীয় শহর শোয়েবো থেকে সশস্ত্র সেনা ও পুলিশ সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন কেথের স্ত্রী একটি হাসপাতালে তাকে পেয়েছে, তবে জীবিত নয়। সুন্দরের কবি কেথকে শুধু মেরেই ফেলা হয়নি, কেটে নেওয়া হয়েছে তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
কেথ থির স্ত্রী আরও বলেন, ‘তারা আমাকে সকালে ফোন করে বলেছিল যে মনুইয়ার হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি ভেবেছিলাম তার হয়ত কেবল একটি হাত ভেঙেছে... কিন্তু আমি যখন এখানে পৌঁছলাম তখন সে মর্গে ছিল এবং তার ভেতরের অঙ্গগুলো ছিল না।’ এই দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। নিদারুণ নির্মম সে দৃশ্য।
কবি পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী। শৈশবে থেকেই কবিতা লিখতেন। জীবন যাপন করতেন অন্যদের তুলনায় আলাদা। যেমন শুধু কবিতা লিখবেন বলে ২০১২ সালে প্রকৌশলীর চাকরি ছেড়ে দেন, কবিতায় মনোনিবেশ করতে। সংসার চালাতে আইসক্রিম এবং কেক তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। নিহত হওয়ার আগে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন যে তিনি একজন গিটার বাদক, কেক বেকার এবং কবি ছিলেন– বন্দুক চালাতে পারে এমন কেউ নন। তবে তিনি ইঙ্গিত দেন যে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।
‘আমার লোকেদের গুলি করা হচ্ছে এবং আমি কেবল কবিতা ফিরিয়ে দিতে পারি,’ তিনি লিখেছিলেন। ‘তবে যখন আপনি নিশ্চিত হন যে আপনার কণ্ঠ যথেষ্ট নয়, তখন আপনাকে সাবধানে একটি বন্দুক বেছে নেওয়া দরকার।’
এইভাবে কবি–সাহিত্যিক যে কেউই মিয়ানমারের সেনা সরকারের বিরুদ্ধে বলেছেন, লিখেছেন তাকেই সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে। কারণ হিসেবে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বার্মিজ কবি, অনুবাদক ও সমকালীন বার্মিজ কবিতার সংকলক কো কো খেট এক জায়গায় বলেন, ‘যেকোনো অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে কবিতা ক্যারিশমার মতো কাজ করে। সাহসকে উসকে দেয় বারুদের মতো।’
কবি ও কবিতা মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। রয়টার্স থেকে জানা যায়, গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান বিক্ষোভে খেত থিসহ কমপক্ষে তিন জন কবি নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে লেখকদের সংগঠন পেন ইন্টারন্যাশনাল বলছে, মিয়ানমারে এ পর্যন্ত ৩২ কবি–লেখককে আটক করা হয়েছে।
মিয়ানমারের রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের কবিরা কবিতা লিখেছেন। একইভাবে আগের সেনাশাসনের বিরুদ্ধেও তারা কবিতা লিখেছেন। সেনা সরকার বহু কবিকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল।
উল্লেখ্য ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে অং সাং সুচির ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসি যখন ক্ষমতায় এল, সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন মিয়ানমারের ১১ জন কবি।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান , বিসিসি বার্মিজ, পেন ইন্টারন্যাশনাল, প্রথম আলো, নিউজ ট্রি, তর্ক বাংলা
Comments