চীনের বিস্ময়কর ‘লাল পর্যটন’!

চীন কমিউনিস্ট রাজনীতিকে দেশ ও দেশের বাইরের জনমানুষের মনোজগতে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘লাল পর্যটন’র দিকে নজর দিয়েছে। কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট নেতারা কীভাবে চীনের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন, রাখছেন—তা তুলে ধরা হচ্ছে পর্যটকদের সামনে।
ছবি: সিএনএন থেকে নেওয়া

চীন কমিউনিস্ট রাজনীতিকে দেশ ও দেশের বাইরের জনমানুষের মনোজগতে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে 'লাল পর্যটন'র দিকে নজর দিয়েছে। কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট নেতারা কীভাবে চীনের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন, রাখছেন—তা তুলে ধরা হচ্ছে পর্যটকদের সামনে।

চীন সম্প্রতি জনপ্রিয়তা পেতে থাকা 'লাল পর্যটন' শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।

চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির জন্যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে গুরুত্ব বহন করে, এরকম কিছু এলাকাকে 'লাল পর্যটন কেন্দ্র' হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। সেসব এলাকায় কর্মরত এক শ জন নির্বাচিত ট্যুর গাইডকে সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাজধানী বেইজিং শহরে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এ প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে লাল সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে গড়ে তোলা।

লাল পর্যটনের ধারণাটি ২০০৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পর্যটন পরিকল্পনার অংশ করা হয়। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্থানীয় পর্যটকদের মধ্যে যা নতুন করে আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। বাইরের দেশগুলোতে ভ্রমণের ওপর এখনো নানারকম বিধি-নিষেধ থাকায় চীনের পর্যটকরা দেশের ভেতরেই বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাচ্ছেন। আর এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে লাল পর্যটনকেন্দ্রগুলো।

আগামী জুলাইয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন লাল পর্যটন কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে এবং এর ফলে বেসরকারি ও সরকারি, উভয় পর্যায়ে পর্যটন শিল্পে এসেছে নতুন উৎসাহের জোয়ার।

সম্প্রতি সিএনএনের সংবাদদাতারা শানজি প্রদেশের ইয়ানান অঞ্চলের লাল পর্যটন কেন্দ্র সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখেছেন, সেখানে অনেক পর্যটক সাবেক কমিউনিস্ট নেতাদের বাড়ি দেখতে গিয়েছেন এবং তাদের অনেকে বিপ্লবীদের মতো করে সেজে এসেছেন।

এরকম আরেকটি অনুষ্ঠান হচ্ছে পার্টি সদস্যদের নতুন করে শপথ নেওয়া। অনেকেই বিপুল উৎসাহ নিয়ে পার্টির মূলনীতি বলছেন জোরালো কণ্ঠে— 'দল ও জাতির কল্যাণে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকব এবং কখনো দলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।'

ইয়ানানের কর্তৃপক্ষ নতুন একটি বিমানবন্দর ও বেশ কিছু চাকচিক্যময় হোটেল তৈরি করে এবং চোখে পড়ার মতো বিশাল একটি বিলবোর্ডের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত, পর্যটনবান্ধব স্টারবাকস কফির দোকান খোলার সংবাদ জানিয়ে শহরটির প্রচারণা চালাচ্ছেন।

মহামারির আগে এসব বিনিয়োগ ভালো সুফল এনেছে। ২০১৯ সালে মাত্র দুই মিলিয়ন বাসিন্দার এই শহরটিতে ৭৩ মিলিয়নেরও বেশি পর্যটক এসেছিলেন, যা এর তিন বছর আগের পর্যটকের সংখ্যার চেয়ে তিন গুণ বেশি ছিল। করোনাভাইরাস আঘাত হানার শুরুতে মন্দা দেখা দিলেও এ বছরের মে দিবসের ছুটির পর থেকে আবারও পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

বিভিন্ন বিশ্লেষক ও ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, 'লাল পর্যটকদের' বেশিরভাগেরই বয়স কম। টংচেং ইলোং নামক ভ্রমণ প্ল্যাটফর্মের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মে দিবসের সময় ওয়েব সার্চ ও বুকিং দেওয়া লাল পর্যটকদের ৪০ শতাংশেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

উন্নত অবকাঠামো ও সেবার মান, সৃজনশীল স্মারক এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে লাল পর্যটন কেন্দ্রগুলো তরুণদের কাছে বেশি আকর্ষণ জাগাতে পেরেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতিগত ঐতিহ্য ও নিজস্বতার বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।

লাল পর্যটনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন ট্যুরিস্ট গাইড ঝ্যাং ইওয়েন বলেন, 'তরুণ প্রজন্ম আজকাল অধিক পরিমাণে গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী এবং তারা আমাদের দেশ ও জাতিগত সত্ত্বার সঙ্গে গভীর একাত্মতা অনুভব করে।' তিনি আরও বলেন, 'তারা জানতে চায় কীভাবে চীন একটি গরিব দেশ থেকে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে।'

হংকংয়ের একজন অধ্যাপক লি বলেছেন, 'তরুণরা দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে চায় এবং নিজের দেশকে আরও ভালো করে চিনতে চায়।'

চীনের সমালোচকরা সতর্ক করেছেন যে, চীনের জাতীয় ইতিহাস সারাবিশ্বের পর্যটকদের আগ্রহের বিষয় হলেও লাল পর্যটন কেন্দ্রগুলো প্রায় সব সময়ই পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এ কেন্দ্রগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে কমিউনিস্ট পার্টি ও নেতাদের বিজয়গাঁথার বিস্তারিত বর্ণনা।

সায়মন শেন নামে হংকং ভিত্তিক এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার বলেন, 'চীন সরকার অবশ্যই বাণিজ্যিক ও নীতিগত কারণে লাল পর্যটনের প্রসার ঘটাতে চাইবে। এটি তাদের দেশপ্রেমের শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তবে, এটি কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, সেটির উত্তর সময়ই বলে দেবে।'

সায়মন শেন চীনের লাল পর্যটনকে উত্তর কোরিয়ার সরকারি প্রভাবযুক্ত ও একমুখী পর্যটনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, 'পর্যটকরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রোপাগান্ডার অংশ হয়ে যেতে পারেন, যদি না তারা পরে প্রকৃত চিত্রটি সম্পর্কে ভালো করে জেনে নেন।'

আমেরিকান গবেষক রবিনসন উল্লেখ করেছেন, বেইজিংয়ের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে লাল পর্যটন শিল্প উন্নয়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এবং এই শিল্পের প্রসারে স্থানীয় জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে।

এ প্রসঙ্গে গুয়াংগান শহরের কথা উল্লেখ করেন তিনি। এটি কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়াত নেতা ডেং জিয়াওপিংয়ের সাবেক বাসস্থান, যেটি প্রথম লাল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সর্বোচ্চ ফাইভ স্টার রেটিং পেয়েছে। ২০০০ সালের শুরু থেকেই এ শহরের উন্নয়ন কার্যক্রম এবং ২০১৭ সালে এটি দরিদ্রসীমা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।

চীনের লাল পর্যটনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে দারিদ্র্য বিমোচন, পল্লী উন্নয়ন, কৃষি খাতের ক্রমবিকাশ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। তবে, একইসঙ্গে এই খাতটি সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে কমিউনিস্ট পার্টিই চিনে সর্বেসর্বা।

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

1h ago