৭ জেলায় লকডাউনের অন্তরায় আম বাণিজ্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরুরি সুপারিশ সত্ত্বেও, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সাতটি জেলার স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সেখানে এখনই লকডাউন দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন।
তারা মনে করছেন, লকডাউন এই অঞ্চলগুলোতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্যে মারাত্মক আঘাত হানবে।
গত শনিবার ডিজিএইচএসের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ কমিটি গত কয়েকদিন ধরে জেলাগুলোতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের উচ্চহারের কারণে নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরায় লকডাউনের সুপারিশ করেছিল।
গত রোববার ডিজিএইচএসের এক ভার্চুয়াল বৈঠকে এই জেলাগুলোর কর্মকর্তারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে এই অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল আমের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলে হাজার হাজার মানুষ জীবিকা হারাবে।
তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশিকা বজায় রাখা এবং আমের বাণিজ্য সচল রাখার পক্ষে কথা বলেছিলেন। তবে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন জেলায় লকডাউনের সুপারিশকে সমর্থন করেছেন।
ডিজিএইচএসের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশিদ আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘আমরা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতামত পেয়েছি। আমরা আগামীকাল (আজ সোমবার) একটি প্রস্তাব চূড়ান্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে।’
এ দিকে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গতকাল করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য দেশব্যাপী নিয়ন্ত্রণ বিধিগুলো আগামী জুন পর্যন্ত আরও এক সপ্তাহের জন্য বাড়িয়েছে।
তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিয়েছে।
গতকালের সভায় বেশিরভাগ স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে তাদের জেলাগুলোর করোনা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেই।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে একটি কঠোর লকডাউন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন... আমের বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা ও হাজার হাজার মানুষের জীবিকা জড়িত।’
‘করোনা পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক নয়’ দাবি করে তিনি জানান যে তারা জীবিকার ওপরে জীবনকে তখনই স্থান দিবেন যখন বোঝা যাবে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ডিজিএইচএসের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক হাবিবুল আহসান তালুকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে এমন করোনা রোগীর সংখ্যা এখনো সহনশীল পর্যায়ে আছে, যদিও সংক্রমণের সংখ্যা বেশি এবং ক্রমশই তা বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘লকডাউনই সর্বোত্তম সমাধান। তবে এটি বেশিরভাগ মানুষের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। কেননা, তাদেরকে জীবিকা জন্য কাজ করতে হয়।’
রাজশাহীর স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, গতকাল এই অঞ্চলে সংক্রমণের হার ছিল ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ, ৪৩৫টি নমুনার মধ্যে ১৯০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই অঞ্চলে প্রধান আমের উৎপাদনকারী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক সপ্তাহের লকডাউন দেওয়া হয়েছিল। আজ এর মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে আগামী ৭ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
এই জেলায় এখনো পর্যন্ত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কমপক্ষে সাত জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। সংক্রামিত কেউই সম্প্রতি ভারতে যাননি।
গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৩৪ শতাংশ।
জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘লকডাউন মানে সবার ক্ষতি। কেউ তা চায় না। আমরা আগামীকাল (আজ) পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসবো।’
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী লকডাউনের পক্ষে জোর সুপারিশ করেছেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের সবগুলো শয্যা ও অক্সিজেন সুবিধা করোনা রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১২ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। কয়েকজন রোগীর মৃত্যুও হচ্ছে। তবুও এখনো আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পারছি। রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে সমস্যা হবে।’
‘আমাদের করোনা ওয়ার্ডে যেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ আছে সেখানে সব শয্যাই পূর্ণ থাকছে। এরপর নতুন রোগী আসলে সিলিন্ডারে অক্সিজেন দেওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের একটি ইউনিট অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে সেখানে নতুন একটি করোনা ওয়ার্ড স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। তবে এজন্য হাসপাতালকে অতিরিক্ত চিকিৎসক ও অন্য জনবল দিতে হবে।’
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হোসেন সাফাত জেলায় লকডাউনের পক্ষে মত দিয়েছেন। কারণ, গতকাল এই জেলায় করোনায় অন্তত চার জনের মৃত্যু হয়েছে। সংক্রমণের হার ছিল ২২ শতাংশের বেশি।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাতক্ষীরায় যেহেতু সংক্রমণের হার খুব বেশি ও হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত চাপ রয়েছে তাই আমি এখানে লকডাউনের প্রস্তাব করেছি। আমরা আগামীকাল (আজ) জেলার কোভিড নিয়ন্ত্রণ কমিটির বৈঠকে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।’
খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ার কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারের উচিত এই অঞ্চলের করোনা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং লকডাউন আরোপের আগে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, গতকাল এই অঞ্চলে করোনা সংক্রমণের হার ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ।
এ দিকে, সরকার বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ১৪ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রতিবেশী ভারতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ায় গত ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ তার সীমান্ত বন্ধ রেখেছে।
তবে, খুলনা বিভাগের ছয় জেলার অনেক লোক অবৈধভাবে ভারতে যাচ্ছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
এই ছয় সীমান্তবর্তী জেলা হলো— সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন-৫৮ এর পরিচালক কামরুল হাসান স্বীকার করেছেন যে অনেক বাংলাদেশি ভারত থেকে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ফিরে আসছেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন, গত ১৭ মে থেকে দর্শনা সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মোট ৭২৫ জন বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল।
(কুষ্টিয়া থেকে আমানুর আমান ও খুলনা থেকে দীপঙ্কর রায় এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন।)
Comments