যেখানে নদীর ভেতরে খাল!

লাল পতাকা দিয়ে নদীর ভেতরে খালের সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়েছে। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) একটি প্রকল্প হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দাদের মাঝে নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করেছে। প্রকল্পটিতে একটি ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও প্রায় ৬০০ ফুট চওড়া নদীর ভেতর ছয় কিলোমিটার লম্বা ও ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন করার কথা বলা হয়েছে।

এলজিইডির কার্যাদেশে প্রকল্পটিকে ‘আরা বরাক খালের মাটি কাটার কাজের নতুন উন্নয়ন উদ্যোগ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এটি একটি নদী এবং স্থানীয়রা এটিকে এরাবরাক নদী নামে জানেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি স্বার্থান্বেষী মহল এলজিইডির ‘ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)’ এর আওতায় খাল পুনঃখননের মিথ্যে প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের ৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এই কাল্পনিক ‘খাল’ উদ্ভাবন করেছেন।

এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি এলজিইডি ৩১টি স্থানীয় ‘লেবার কন্ট্রাকটিং সোসাইটি (এলসিএস)’ কে একটি কার্যাদেশ দেয়। এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে কাজী শাহেদ বিন জাফর নামের একজনকে ‘এরাবরাক খাল উপ-প্রকল্প এলসিএস কমিটির সভাপতি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

কেন কার্যাদেশে এরাবরাক নদীকে খাল হিসেবে দেখানো হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তরে কাজী শাহেদ বিন জাফর দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সরকার প্রকল্পটিকে কমিটির কাছে হস্তান্তরের সময় এটিকে খাল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ‘আমরা শুধুমাত্র সরকারি আদেশের বাস্তবায়ন করছি।’

নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের উত্তর দৌলতপুর গ্রামের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা জয়নুল আবেদিন জানান, যদিও উপজেলার বাসিন্দারা বড় বাঁকের জন্য নদীটিকে এরাবরাক নামে চিনলেও ১৯৫৬ ও ১৯৯৫ সালের ভূমি রেকর্ডে এটিকে বরাক নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বরাক নদীর উৎপত্তি হয়েছে বিজনা নদী থেকে এবং এটি হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর ভাগ হয়ে দুইটি ভিন্ন ধারায় চলে গিয়েছে। একটি শাখা কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলে গিয়েছে আর অন্যটি শেরপুরের বেরী বিলের কাছে এসে মিশেছে।

একই অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তি মহসীন আহমেদ বলেন, এরাবরাক নদী বর্ষাকালে পানিতে পুরোপুরি ভরে গিয়ে স্থানীয়দের জন্য অনেক ভোগান্তির সৃষ্টি করে। সম্প্রতি বছরজুড়ে যোগাযোগব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ সাত কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর ওপর একটি সেতু তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

‘আউশকান্দি এরাবরাক নদী প্রতিরক্ষা আঞ্চলিক কমিটির’ প্রধান সমন্বয়ক কাজি আবদুল বাসিত বলেন, আউশকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহিবুর রহমান হারুন সহ একটি স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশে এত বড় একটি নদীকে কাগজে কলমে খালে রূপান্তর করে দিয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তারা এবং স্থানীয়রা যোগসাজশ করে এসব করছে, কিন্তু আমরা যেকোনো মূল্যে তাদের হাত থেকে এরাবরাক নদীকে রক্ষা করব।

আউশকান্দি গ্রামের বাসিন্দা শিহাব আহমেদ বলেন, যদিও নিয়ম অনুযায়ী এলসিএস এর সদস্যদের বাড়ি প্রকল্প এলাকার পাশেই থাকতে হবে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কাজী শাহেদ বিন জাফর (এলসিএস কমিটির সভাপতি) এর বাড়ি নদী থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে।

তাদের সাজানো প্রকল্পে তারা শুধুমাত্র এরাবরাক নদীকে খাল হিসেবে চিহ্নিত করেই থামেননি, তারা ৩১টি এলসিএস এর বেশিরভাগগুলোতে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের আত্মীয় স্বজনদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এছাড়াও, প্রকল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী নদীর ঘাটের জন্য ৩০ ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করার নিয়ম থাকলেও তারা মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করেছেন।

তিনি আরও জানান, স্থানীয়রা এবং ‘আউশকান্দি এরাবরাক নদী প্রতিরক্ষা আঞ্চলিক কমিটির’ সদস্যরা মিছিল ও মানববন্ধনের মাধ্যমে এরাবরাক নদী ও এর চারপাশের পরিবেশকে ধ্বংস করে দিয়ে সরকারি তহবিল তছরুপের চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার এর তোফাজ্জল সোহেল জানান, খনন করা মাটি উভয় পাশে স্তূপ করে রাখার কারণে নদীর স্রোত বিঘ্নিত হচ্ছে।

স্বভাবতই, নদীর ওপর দিয়ে খনন করা খালটি পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করবে এবং এর ফলশ্রুতিতে নদীর তীর ভাঙতে থাকবে ও ফসলী জমি ও বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি হবে, জানান সোহেল।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য আবদুল করিম কিম বলেন নদী ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং অন্য সকল জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা উচিত।

অভিযোগের উত্তরে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহিবুর রহমান হারুন দাবি করেন যে সমগ্র এরাবরাক নদীর বুক থেকে পলিমাটি সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য থাকলেও তারা ‘ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)’ এর প্রকল্প নীতিমালার আওতায় আসতে এটিকে খাল হিসেবে দেখাতে বাধ্য হয়েছেন।

এছাড়াও এই প্রকল্পের শর্ত হিসেবে ১০০ ফুট খালটির উভয় পাশে খনন করা মাটি বিছিয়ে রাখতে হবে।

এলসিএস এর ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগের উত্তরে তিনি বলেন তার আত্মীয় স্বজনরা সমগ্র আউশকান্দি ইউনিয়ন জুড়ে থাকেন এবং এটি খুবই স্বাভাবিক যে তাদের কারো কারো নাম এলসিএস এর তালিকায় থাকবে।

হবিগঞ্জে এলজিইডির ‘ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)’ এর সহকারী প্রকৌশলী মাজহার ইবনে মুবারাক এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

যোগাযোগ করা হলে হবিগঞ্জের এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল বশির বলেন, ‘যদি প্রকল্পটি জনমানুষ-বান্ধব না হয় অথবা এর নকশায় যদি কোনও ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে সেটি সংশোধন করার জন্য একটি প্রতিবেদন পাঠানো হবে। আমরা এমন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করব না যা থেকে মানুষের কোন উপকার হবে না। এ ব্যাপারটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না কারণ তিনি এখানে সম্প্রতি যোগদান করেছেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সচিব আমিনুল ইসলাম বলেন এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ পেলে তারা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।

প্রখ্যাত পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত জানান, যখন একটি নদী খনন করা হয়, তখন তা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিকল্পিত ভাবে করতে হয়। অন্য কোনোভাবে এ কাজটি করা হলে তাতে ফল আসবে না।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Produce 10 ex-ministers, 2 advisers to Hasina before tribunal on Nov 18: ICT

They will be shown arrested in case filed over crimes against humanity, genocide, says prosecutor

32m ago