মুক্তিযুদ্ধ

৩০ মে ১৯৭১: কাঠিরা গণহত্যা

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ মে ছিল ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন পাকিস্তানি হানাদারেরা বরিশালের আগৈলঝাড়ার কাঠিরা গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়।
কাঠিরা গণহত্যায় স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের নামের তালিকা।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ মে ছিল ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন পাকিস্তানি হানাদারেরা বরিশালের আগৈলঝাড়ার কাঠিরা গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দেওয়া এক বিবৃতির প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন 'পাকিস্তান বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়।' ইয়াহিয়া খানের এমন বক্তব্যে এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, 'ইয়াহিয়া খানের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় যে মতৈক্য হয়, ইয়াহিয়া খান তা ঘোষণা করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এর বদলে তিনি বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। তার কথা তাই মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন ৯৮ শতাংশের বেশি মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। তাদের সরকারকে প্রশ্ন বা বিচার করার অধিকার মানুষ তাদের দেয়নি।' 

আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তব্য

৩০ মে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে এক সভায় বক্তব্য দেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী। এর আগের দিন তিনি নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে ফিরে এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। এই সভায় আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, '২৫শে মার্চ কালরাত থেকে যেভাবে বাংলার নিরীহ নরনারীর উপরে গণহত্যা ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে তা বর্ণনা করার মতো না। এখন পুরো বিশ্বেই বাংলাদেশের মানুষ জেগে উঠেছে।’ আবু সাঈদ চৌধুরী একাধারে যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালিদের তৎপরতা, বাঙালিদের সহায়তার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন 'বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। এখন বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চায়।'

রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি, রাজনীতিবিদদের বিবৃতি 

৩০ মে এডওয়ার্ড কেনেডিসহ বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করে সিনেটে বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন বাংলাদেশ যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তাকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।' একই সঙ্গে মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত কমিটি পাকিস্তানকে সব প্রকার আর্থিকভাবে সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব বাতিল করে দেয়।

৩০ মে সুইডেনের সব রাজনৈতিক দল একসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার আহ্বান জানায়। তারা এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশের সকল মানুষের গণতান্ত্রিকভাবে রায় প্রদানের ক্ষমতা আছে। তাদের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া কোন ধরনের পৈশাচিকতা? আমরা স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশিদের প্রতি সমর্থন পোষণ করি।'

৩০ মে ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশটির স্পিকার জাইচেক বিশ্ব মুসলিম সমাজের কাছে পূর্ব পাকিস্তানে সহায়তা করার জন্য আবেদন জানান। তিনি বলেন, 'আজকের এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন কি কোনো মুসলিম দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গের কানে পৌঁছাচ্ছে না? আজ এই অবস্থায় পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতা প্রাপ্য। এখন সমগ্র মুসলিম বিশ্বের নেতারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না।

ভারতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এদিন

৩০ মে ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর দিল্লিতে বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা রোগ মোকাবিলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত সচেষ্ট হচ্ছে।’

৩০ মে ভারতে গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আর আর দিবাকর পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ সীমান্তে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। এতো নিরীহ নরনারীর আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না।

দেশজুড়ে গণহত্যা, প্রতিরোধযুদ্ধ

কাঠিরা গণহত্যা

৩০ মে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়ার গৈলা ইউনিয়নের কাঠিরা গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ৫০ জনের বেশি মানুষ।

এর আগের দিন ২৯ মে শনিবাদ ছিল কাঠিরার গ্রাম্য হাটের দিন। সেদিন পুরো হাট ছিল মানুষের পদচারনায় ভর্তি। দুপুর আড়াইটার দিকে প্রফুল্ল আরিন্দা নামের এক শান্তিবাহিনীর সদস্য ৪০টা রিকশা ভাড়া করেন গৌরনদী থানায় যাওয়ার জন্য।

৩০ মে ভোরে এই রিকশায় করে হানাদারেরা গৌরনদী থেকে কাঠিরায় আসবে এমন তথ্য শোনার পর সেদিনের হাট সন্ধ্যার আগেই ভেঙে যায়। সে রাত ঘুমাতে পারেনি গ্রামের মানুষ। 

৩০ মে সকাল ৮টার দিকে হানাদারেরা ঘোড়ারপাড় গ্রামের পাশ দিয়ে কাঠিরায় অতর্কিত হামলা চালায়। হানাদারদের কাঠিরায় নিয়ে এসেছিলেন প্রফুল্ল আরিন্দা। প্রাণে বাঁচার আশায় নিরীহ মানুষেরা গ্রামের গির্জায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। গির্জার যাজক মাইকেল সুশীল অধিকারীর উপর তাদের আস্থা ছিল তিনি তাদের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করবেন। এর মধ্যেই হানাদারেরা গির্জার চারপাশ ঘিরে ফেলে। এদিকে গির্জায় আসার পথে অজস্র নরনারীকে হত্যা করেছিল হানাদারেরা। গির্জা ঘিরে ফেলার সময় গির্জার চারপাশে মেশিনগান তাক করে হানাদারেরা। এরপর হানাদারেরা গির্জায় আশ্রয় নেয়া অপেক্ষাকৃত তরুণদের ধরে এনে গির্জা চত্বরে লাইনে দাঁড় করায়। মাইকেল সুশীল অধিকারীকে এক হানাদার সেনা লাথি দিয়ে ফেলে দেয়। তারা গির্জা খুঁজে দেখে অস্ত্র লুকানো রয়েছে কিনা। এসময় হানাদারদের কমান্ডার মাইকেল সুশীল অধিকারীকে বলে, 'ইধার হিন্দু হ্যায়?'

জবাবে সুশীল অধিকারী বলেন, এখানে উপস্থিত সবাই খ্রিস্টান। এই কথা বলার পর হানাদারেরা গির্জায় আশ্রয় নেয়া বাকিদের হত্যা করেনি। মাইকেল সুশীল অধিকারীর কারণে সেদিন প্রাণে বেঁচে যায় অজস্র গ্রামবাসী। 

বরগুনা কারাগারে গণহত্যা 

৩০ মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশে পাকিস্তান হানাদারদের একটি দল দ্বিতীয় দিনের মতো এদিন বরগুনা জেলখানায় বন্দি ১৭ জন বাঙালিকে হত্যা করে। এর আগের দিন ২৯ মে বরগুনা জেলখানায় বন্দিদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালানো শুরু করেছিল হানাদার বাহিনী। ওই দিন শহীদ হন ৫৫ জন বন্দি। 

দুদিনের গণহত্যায় শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২ জনে।

৩০ মে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা একটি দল ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চৌদ্দগ্রাম-মিয়ারবাজারে হানাদার বাহিনীর ২৭ জনের একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় তিন হানাদার সেনা নিহত হয়।

৩০ মে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল কুমিল্লার গোমতী বাঁধের উপর থেকে বিবিবাজারে হানাদার বাহিনীর অবস্থানে আঘাত হানে। এতে কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত ও আহত হয়।

৩০ মে মুক্তিবাহিনীর একটি মর্টার প্লাটুন কুমিল্লার সিঙ্গারবিলের অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালালে হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

৩০ মে পাকিস্তান সরকার ভারত থেকে দেশে ফেরত আসতে চাওয়া শরণার্থীদের জন্য অভ্যর্থনা শিবির খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিন পাকিস্তান সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে ক্ষুদ্র বিবাদ ও বিরোধ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, আমরা আশা করছি তা শিগগির মিটে যাবে।

তথ্যসূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম, নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ খণ্ড। 

কাঠিরা গণহত্যা/ হিমু অধিকারী

দৈনিক পাকিস্তান, ৩১ মে ১৯৭১ 

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৩১ মে ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ মে ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago