অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট

বিসিএস কি চাকরিক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে ঢোকার অপেক্ষায় থাকা শিক্ষার্থীদের সারি। ছবি: আনিসুর রহমান/ স্টার ফাইল ফটো

করোনা মহামারি শুরুর আগে, কোনো এক কর্ম ব্যস্ত দিন। সময় সকাল সাড়ে ৮টা। বাংলাদেশের একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। একই সময়ে দেখা গেল, আরও অনেক শিক্ষার্থীর একটা ঢেউ যেন সেখানে আছড়ে পড়েছে। এই ভিড়ের পেছনের কারণটি জানা না থাকলে অনেকের কাছে দৃশ্যটি খুব মনোমুগ্ধকর মনে হতে পারে। তারা মনে করতেই পারেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা ভিড় করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, গ্রন্থাগার এমন জায়গা যেখানে পারস্পরিক বিনিময়ের ভেতর দিয়ে পড়ার বিষয়গুলো আরও পোক্ত হয়ে ওঠে। পাঠে উন্নতি হয়।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের এই সমাবেশ কোনো ক্লাস প্রজেক্টের জন্য নয়। জার্নালে প্রকাশিত নতুন কোনো প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হওয়া কিংবা গবেষণা কাজের জন্যও নয়। শিক্ষার্থীরা এখানে সমবেত হন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের লোভনীয় সব চাকরির জন্য নিজেদের তৈরি করতে। বর্তমান সময়ে যা অনেক শিক্ষার্থীর কাছে পরম আরাধ্য।

গ্রন্থাগারের ভেতরের দৃশ্যটিও কিন্তু বিস্মিত হওয়ার মতো। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে এমপিথ্রি, ওরাকল, অ্যাসিউরেন্স ও কনফিডেন্স পাবলিকেশন্সের নানা বই ও আনুষঙ্গিক প্রকাশনা। গ্রন্থাগারের প্রতিটি কোণা ও পাঠের টেবিলগুলো দখল করে নেওয়া এই প্রকাশনাগুলো সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।

গ্রন্থাগার ভবনের ভেতরে একজনকে দেখা গেল, পড়ার টেবিলের পার্টিশন বোর্ডটিকে মানচিত্র দেখার কাজে ব্যবহার করতে। পড়ার টেবিল ছাড়াও মেঝেতেও জায়গা করে নিয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে শেলফে রাখা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ও গবেষণা জার্নালগুলোতে জমেছে ধুলার স্তর। কেউ কৌতূহলের বশেও সেগুলো ছুঁয়ে দেখছে না।

কেবল সুমনের বিশ্ববিদ্যালয় না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও বিসিএসপ্রেমীদের এমন মগ্নতা দেখা যাবে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বেতন কাঠামোতে পরিবর্তন আসায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা অনেক শিক্ষার্থী এখন সরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এমনকি বুয়েট কিংবা মেডিকেলের অনেক শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা শেষ করেই বিসিএসের তুলনায় দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ বেতনে অন্য চাকরিতে ঢোকা অপেক্ষাকৃত সহজ। তারাও নিজেদের বিসিএসের জন্য তৈরি করছেন। আসলে এটাই এখনকার ট্রেন্ড।

স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা অনেকের কাছে সামাজিক মর্যাদা, সম্মান, ক্ষমতা ও আর্থিক লাভের পাশাপাশি চাকরির স্থিতিশীলতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর ওপর বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনেক শিক্ষার্থীকে সরকারি চাকরির দিকে ধাবিত করছে। আবার অনেকের মতে কেবল বেতনই বিসিএস ট্রেন্ডের একমাত্র কারণ নয়।

মাত্র ছয় বছরেরও কম সময়ে বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ৩৫তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৪৪ হাজার। আর আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া ৪১তম বিসিএসে তা চার লাখ ৭৫ হাজারে পৌঁছেছে। আবেদনের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বিসিএসের চলতি ট্রেন্ডকেই নির্দেশ করে।

একটা রাষ্ট্র সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বকে কেউ খাটো করতে পারবে না। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা, স্বচ্ছতা, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে চলার মতো বিষয়গুলো নাগরিকদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। কিন্তু চলমান প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক পদে যাওয়ার জন্য একজন মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী কি যথাযথ কারিগরি পদ (কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা অথবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন) পান? কিংবা যে জায়গাগুলোতে তাদের অবদান রাখার সুযোগ ছিল, মূল দক্ষতা বিকাশের সুযোগ ছিল সে জায়গাগুলো কী তারা পাচ্ছেন? আবার যদি তারা পুলিশ, ইনকাম ট্যাক্স কিংবা অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে যান তাহলে কি সেটা তাদের মূল শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না?

আমাদের মানবসম্পদ প্রশিক্ষণের জন্য খাত ভেদে আলাদা ব্যয় করা হয়। এ ক্ষেত্রে কারও খাত বদল হলে পুনরায় প্রশিক্ষণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে পূর্বের শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণও অব্যবহার্য হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে মানবসম্পদ প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের ক্ষতিটাও অপূরণীয় হয়ে উঠতে পারে।

এই চলতি ধারা, এমনকি দেশের বেসরকারি খাতকেও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের এক প্রতিবেদন অনুসারে প্রতি বছর বাংলাদেশে বিশেষ বিশেষ কাজে বিদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য তিন দশমিক এক বিলিয়ন ডলার অপচয় হয়। কারণ, বাংলাদেশ তা স্থানীয় পর্যায় থেকে নিয়োগ দিতে পারে না। তাই টিআইবির প্রতিবেদনে যে অপচয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা আসলে অনেক বেশি।

দেশে লাখো শিক্ষিত বেকার থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব মোটা বেতনে প্রবাসী কর্মী আসার পথ সুগম করছে।

অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট পরিচালিত জরিপের তথ্য বলছে, শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আর চাকরির সম্ভাবনার সঙ্গে কোনো সংযোগই নেই। আবার শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ নিজ নিজ বিভাগীয় পড়াশোনার ক্ষেত্রেও মনোযোগী হন না। তারা কেবল একটা সনদ চান বিসিএসে অংশ নেওয়ার জন্য।

সরকারি চাকরির এই আকাঙ্ক্ষা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীকে কর্মহীনও করে তুলতে পারে। ৩০ বছর বয়সের মধ্যে আবেদন থেকে শুরু করে চাকরি পাওয়া পর্যন্ত সময় অনেকে এই কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। নিজ পরিসরে কাজের খোঁজ করেন না। এ অবস্থায় বয়স সীমার মধ্যে যদি কেউ কাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন তাহলে তার লম্বা সময় ধরে বেকার থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণ সাধারণত বেসরকারি খাত স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার এক বছরের মধ্যেই নতুনদের নিয়োগ দিয়ে থাকে।

একজন শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পরিসর আর তার কাঙ্ক্ষিত চাকরির সঙ্গে সংযোগহীনতার বিষয়টি সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিজ পরিসরেই কাজ খুঁজে নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার সময় হয়েছে।

এটা কেবল অ্যাকাডেমিক ব্যাপার নয়, সরকারের নীতি নির্ধারণেরও প্রশ্ন। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাত ও অ্যাকাডেমিকদের সঙ্গে নিয়ে সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে কাজের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য যা একই সঙ্গে আকর্ষণীয় বেতনে অর্থবহ চাকরির নিশ্চয়তা দেবে। পাশাপাশি যেসব সুযোগ-সুবিধা সরকারি চাকরির প্রতি আকাঙ্ক্ষার এই ধারা তৈরি করেছে সেটাও পুনর্মূল্যায়ণ হওয়া উচিত।

 

ইকরামুল গফুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট’-এ অবদান রাখতে ইচ্ছুক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

3h ago