১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পহেলা জুন ছিল ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন পাকিস্তান সরকার পশ্চিম জার্মানির সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বেতার কেন্দ্র নতুন করে চালু হয়েছে। পূর্বে এই বেতার আগরতলায় ১ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল।
ভারতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এদিন
প্রবাসী সরকারের সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
১ জুন দিল্লিতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ফণীভূষণ মজুমদার। তিন সদস্যের সংসদীয় প্রতিনিধি দলের বাকি সদস্যরা হলেন জাতীয় পরিষদের সদস্য নূরজাহান মুর্শিদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।
এসময় তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি যথাক্রমে ৪৫ মিনিট ও ২০ মিনিট প্রতিনিধি দলের বক্তব্য শোনেন। ইন্দিরা গান্ধী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'ভারত সব ধরনের সহযোগিতা করবে বাংলাদেশকে।'
১ জুন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দল লোকসভায় বক্তব্য দেন। তারা লোকসভায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পটভূমি তুলে ধরেন এবং একই সঙ্গে বৈশ্বিক জনমত গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার তার বক্তব্যে বলেন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারতের দ্বিধা বোধগম্য নয়। ভারত সম্ভবত পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং আন্তর্জাতিক জটিলতা এড়াতে চায়। পাকিস্তানের অপপ্রচারের ভয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করা ঠিক নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ। আজ হোক কাল হোক পাকিস্তানি হানাদারেরা এই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
১ জুন ত্রিপুরার আগরতলায় পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশের ১১ জন সাংবাদিক।
বিদেশি সংবাদপত্রে এদিন মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট সংবাদ
১ জুন আফগানিস্তানের কাবুল থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ক্যারাভান সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের বক্তব্যের উদ্ধৃত করে বলে, খান আবদুল গাফফার খান এখনও আওয়ামী লীগের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যস্থতা করতে রাজি আছেন। খান আবদুল গাফফার খান এর আগে তার বিবৃতিতে বলেছিলেন 'আমি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে। কারণ পূর্ব পাকিস্তান তো বটেই পশ্চিম পাকিস্তানেও জয়ী হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। তারাই সংখ্যাগুরু অথচ তাদের প্রতি অবিচার করে ক্ষমতার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হয়নি। তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি দেশের দায়ভার।'
১ জুন লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের মুখপাত্র পাকিস্তান নিউজ পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্টজনদের দেওয়া একটি গণ বিবৃতি প্রকাশ করে। ১৬ মে অবরুদ্ধ ঢাকায় পাকিস্তান সরকারের চাপের মুখে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী ও চলচ্চিত্রকার এই গণবিবৃতিটি দিয়েছিলেন।
ঢাকায় এদিন
১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ড. এম এন হুদা, ড. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, ড. এম ইন্নাস আলী, ড. এ কে নাজমুল করিম, ড. মফিজুল্লাহ, কবির, অধ্যাপক আতিকুজ্জামান খান, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ড. কাজী দীন মুহাম্মদ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. এস এম আজিজুল হক, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ড. এ কে রফিকুল্লাহসহ প্রায় সব শিক্ষক কাজে যোগ দিয়েছেন।
১ জুন পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল মওলানা নুরুজ্জামান ঢাকার দিলকুশায় ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করেন। ৩০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক মনোনীত হন জামশেদ আলী ও আমীর বকশ।
দেশজুড়ে গণহত্যা ও প্রতিরোধযুদ্ধ
নগরকান্দা গণহত্যা
১ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ফরিদপুরের নগরকান্দার কয়েকটি গ্রামে গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় নরনারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ৩৮ জন মানুষ শহীদ হন।
ঘটনার শুরু ২৯ মে। ওই দিন হানাদার বাহিনী নগরকান্দার চাঁদহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে ভিত হয়ে পড়লেও পাশাপাশি সাধারণ মানুষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতে দেখে, মুক্তিযোদ্ধারা দোর্দণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ঘোড়ামারা বিল, দিঘলিয়া বিল, দমদম খালে চলমান এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও বিভিন্ন গ্রামের মানুষের হাতে ২৬ পাকিস্তানি হানাদার সেনা নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি হানাদারেরা ফরিদপুর থেকে আরও সৈন্য আনে। তারপর ১ জুন হানাদার সেনা নগরকান্দার কোদালিয়া, ছোট শ্রীবর্দি, বাগাট, ঈশ্বরদী, শেখরকান্দি, ঘোনাপাড়া, রঘুরদিয়া, পুরাপাড়া, ছোট পাইককান্দি, বড় পাইককান্দি, বাস্তপুটিসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর নির্বিচারে চালানো হয় গণহত্যা, ধর্ষণ। গণহত্যা শেষে হানাদারেরা অজস্র ঘর-বাড়ি গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
১ জুন মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নির্দেশে পাকিস্তানি হানাদারেরা রাজাকারদের সহযোগিতায় বাগেরহাটের শরণখোলা থানার দোতলা বিল্ডিং এ ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শরণখোলার আওয়ামী লীগ ও ভাসানী ন্যাপের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, নির্যাতন, হত্যা, তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে।
১ জুন রাজাকারেরা ঝালকাঠির নলছিটির বিরাট গ্রাম থেকে বরিশাল জেলা আদালতের প্রখ্যাত আইনজীবী জিতেন্দ্রলাল দত্ত, তার ছেলে সাংবাদিক মিহিরলাল দত্ত, সুধীরলাল দত্ত এবং পরিবারের বেশ কজন সদস্য ও আশেপাশের প্রতিবেশীদের তুলে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে সোপর্দ করে।
১ জুন মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী কুমিল্লার মন্দভাগ ও শালদা নদী এলাকার অবস্থান ফেলে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে তাদের নতুন ঘাঁটি স্থাপন করলে মন্দভাগ ও শালদা নদী মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। গোপালগঞ্জের রাজপুরে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগে রাজপুরই সর্বপ্রথম মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১ জুন মুক্তিবাহিনীর চাঁদগাজী প্রতিরক্ষা ব্যুহের দায়িত্বে ক্যাপ্টেন অলির স্থলাভিষিক্ত হন ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা।
১ জুন ময়মনসিংহে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর গোপন ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ চালায়। অপরদিকে হানাদার সেনারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বহু তরুণকে গ্রেপ্তার করে এবং বহু নিরীহ মানুষ বর্বর পৈশাচিকতায় শহীদ হন।
তথ্যসূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সপ্তম, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ খণ্ড।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ জুন, ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ২ জুন ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক
Comments