সমারটন ম্যান: মৃত্যুর ৭০ বছর পর রহস্য উন্মোচনের দ্বারপ্রান্তে
বাস্তব জীবনের রহস্য কখনও স্টিফেন কিং এর উপন্যাসের গল্প কিংবা গোয়েন্দা ফেলুদার রহস্য রোমাঞ্চের চেয়েও চমকপ্রদ হতে পারে। ১৯৪৮ সালে ‘সমারটন ম্যান’র মৃত্যুর ঘটনা সেরকমই এক উপাখ্যান।
সত্তর বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও তার মৃত্যুকে ঘিরে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত মৃত্যুর ঘটনাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
এডিলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেরেক অ্যাবট ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো সমারটন ম্যানের গল্পটি শোনেন। তারপর, তিনি অনেক বছর ধরে এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য কবর থেকে সমারটন ম্যানের মরদেহ তুলে ডিএনএ বিশ্লেষণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
অবশেষে এত বছর পর মি. এস নামেও পরিচিত এই অজ্ঞাত ব্যক্তির দেহাবশেষ তুলে এনে নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। খুব শিগগির হয়তো দীর্ঘদিনের এই রহস্যের অবসান ঘটবে।
সেদিন কী ঘটেছিল?
অস্ট্রেলিয়ার এডিলেইডের সমারটন সমুদ্র তটে চকচকে বাদামি স্যুট ও সদ্য পালিশ করা জুতো পরা অবস্থায় এক ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাশে অর্ধেক পোড়া সিগারেট।
সকালবেলায় হাঁটতে আসা মানুষেরা দেখেন বালুর ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন এক ব্যক্তি। তার মাথা ও ঘাড় সমুদ্রের দিকে ফেরানো ছিল। দিনটি ছিল ১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে সমুদ্র তটে চৌকস সাজে সজ্জিত লোকটিকে খুবই বেমানান লাগছিল।
পরবর্তীতে অনেকেই দাবি করেন যে তারা মি. এসকে তার আগের রাতেও একই জায়গায় শুয়ে থাকতে দেখেছেন, কিন্তু তার হাত নড়ছিল দেখে তারা পুলিশকে সংবাদ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।
ময়নাতদন্ত হয়েছিল, কিন্তু তাতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। এমনকি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট কারণও জানা যায়নি।
তিন জন মেডিকেল বিশেষজ্ঞ জানিয়েছিলেন যে, তার মৃত্যুর কারণটি স্বাভাবিক নয়। একজন গোয়েন্দা ধারণা করেছিলেন যে তিনি এমন এক ধরনের বিষ পান করেছিলেন যার কোনো চিহ্ন শরীরে খুঁজে পাওয়া যায় না। ময়নাতদন্তে তার শরীরে কোনো বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
সমারটন ম্যান স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তার বয়স ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে ছিল ও তার উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি।
কারো কারো মতে তিনি ইউরোপীয় ছিলেন। তার পোশাকের সব তকমা তুলে ফেলা হয়েছিল যা রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। কেউ তাকে নাচিয়ে, কালোবাজারি, নাবিক, এমনকি গুপ্তচর হিসেবেও অভিহিত করেন।
‘অজ্ঞাতনামা মানুষ’ এর গল্পটি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সব পত্রপত্রিকার শিরোনামে চলে আসে এবং তার আঙ্গুলের ছাপ ও ছবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
১৯৪৯ সালের একটি চিঠি থেকে সিএনএন জানতে পেরেছে যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর পরিচালক জন এডগার হুভার নিশ্চিত করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার আঙ্গুলের ছাপের কোনো নথি পাওয়া যায়নি।
বেশ কয়েকজন ব্যক্তি তাকে চেনার দাবি করলেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কারো দাবি ধোপে টেকেনি। সমারটন ম্যানের মরদেহটিকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে পুলিশ তাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে পারে।
প্লাস্টারের মাধ্যমে মুখের একটি অনুলিপি তৈরি করা হয়, যাকে সে সময় ‘ডেথ মাস্ক’ বা ‘মৃত্যু মুখোশ’ বলা হতো।
তামাম শুদ এর সঙ্গে যোগসূত্র
সমারটন ম্যানকে কবর দেওয়ার আগে কিছু সূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন গোয়েন্দারা।
পকেটে থাকা ট্রেনের টিকিটের অবশিষ্টাংশ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি ঘটনার আগের দিন কোনো একটি অজানা জায়গা থেকে এডিলেইডে এসেছিলেন। আরও পাওয়া যায় হেনলি বিচে যাওয়ার জন্য কেনা অব্যবহৃত টিকিট।
ক্লেল্যান্ড নামের এক প্যাথলোজিস্ট তার পোশাকগুলো আবারও পরীক্ষা করে প্যান্টের পেছনে একটি গোপন পকেট খুঁজে পান। পকেটে একটি ভাজ করা কাগজে ‘তামাম শুদ’ শব্দ দুটি লেখা ছিল। ফার্সি ভাষায় এর অর্থ ‘যবনিকাপাত’ বা ‘শেষ হওয়া’। এই শব্দ দুটি ১১ শতকের প্রখ্যাত কবি ও বহু বিষয়ে প্রতিভাবান ওমর খৈয়ামের লেখা এক কবিতাটির শেষ দুটি শব্দ। একটি বই থেকে কাগজটি ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছিল, যেটি পরবর্তীতে পুলিশ খুঁজে পায়। বইটির ভেতরে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
এই কবিতার লাইনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ বলেছেন যে সমারটন ম্যানের জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল, তাই তিনি বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন।
তদন্তকারী গোয়েন্দাদের মাঝে অন্যতম লেনার্ড ব্রাউন ও প্যাথোলজিস্ট ক্লেল্যান্ড ও একই ধারণা করেছিলেন। বই এর পেছনের প্রচ্ছদে হাতে লেখা একটি ফোন নম্বর খুঁজে পাওয়া যায়। ফোন নম্বরের মালিক এক নারীকেও পুলিশ খুঁজে পায়। তিনি সমারটন ম্যানের ‘মৃত্যু মুখোশ’ দেখে ভীত হয়ে পড়েন, কিন্তু তাকে চেনেন না বলে জানান।
ফোন নম্বরের পাশে এলোমেলোভাবে লেখা কিছু অক্ষরকে গোপন সংকেত হিসেবে ধরে নেয় পুলিশ। তবে এত বছরেও এর কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে যুগে অনেকে ভেবেছিলেন সমারটন ম্যান একজন গুপ্তচর এবং তিনি গোপন সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
এরপর নতুন আর কোনো তথ্যসূত্র বা অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো প্রক্রিয়া খুঁজে না পেয়ে অবশেষে গোয়েন্দারা জুন ১৯৪৯ এ মরদেহটিকে কবর দেওয়ার অনুমতি দেন।
ডেরেক অ্যাবটের অনুসন্ধান
ডেরেক অ্যাবট ও তার ছাত্ররা সংখ্যাগুলোকে বিশ্লেষণ করে অভিমত দেন যে এ অক্ষরগুলো হয়তো কিছু নামের আদ্যাক্ষর, যেমন যেসব স্থানে সমারটন ম্যান ঘুরতে গিয়েছিলেন অথবা যেসব ঘোড়ার নামে তিনি বাজি ধরেছিলেন, এসব।
অ্যাবটও সেই রহস্যময় ফোন নম্বরের মালিক জো টমসনকে খুঁজে পান। কিন্তু, জো ও তার পুত্র রবিন দুজনই মারা গেছেন। অবশেষে তিনি রবিনের মেয়ে র্যাচেল এগানকে খুঁজে পান। ঘটনাচক্রে র্যাচেল এখন অ্যাবটের বিবাহিত স্ত্রী। র্যাচেল এগান সমারটন ম্যানের সঙ্গে তার ও তার পরিবারের যোগসূত্রের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
অ্যাবটের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হওয়ার পর এগান ও তার পরিবারের কাছে ‘মিস্টার এস’ একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। তার পরিচয়ের ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত না হলেও তারা দুই জন ও তাদের তিন সন্তানের কাছে তিনি পরম আত্মীয়র মতোই।
নতুন ডিএনএ পরীক্ষা
সমারটন ম্যানের দেহাবশেষ বর্তমানে এডিলেইডের ফরেনসিক সায়েন্স এসএ গবেষণাগারে রয়েছে, যেখানে বিজ্ঞানীরা এর বিশ্লেষণ করতে প্রস্তুত। দীর্ঘদিন মাটির নিচে থাকা ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের কারণে পুনঃপরীক্ষার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে ভাবছেন তারা।
বিজ্ঞানীরা একটি ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করার চেষ্টা করবেন, আর তা সম্ভব হলে এডিলেইডসহ সমগ্র অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দাদের ডিএনএ ডেটাবেজের সঙ্গে এর তুলনা করে জীবিত বংশধরদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হবে।
অধ্যাপক অ্যাবট সিএনএন’কে জানান, ‘এ ধরনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর সমাধান হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছরও লেগে যায়। তাই আমি প্রয়োজনে দুই বছরও অপেক্ষা করতে রাজি আছি।’
পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক না কেন, একটি কথাই প্রমাণিত হবে যে প্রযুক্তি, আগ্রহ ও মানুষের অনুসন্ধানী মনের কাছে কোনো রহস্যই চিরকাল রহস্য থাকে না।
Comments