অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট

নিরাপত্তাহীনতা: নারী শিক্ষার্থীদের ওপর এক ভীতিকর ছায়া

নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে ঢাবি শিক্ষার্থীদের র‌্যালি। ৫ জুন ২০১৮। ছবি: আমরান হোসেন

বুয়েট শিক্ষার্থীরা এখনও সাবিকুন নাহার সনি হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলতে পারেননি। ২০০২ সালের জুনে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সংঘর্ষের বলি হন তিনি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে যে ক্যাম্পাসে পা রেখেছিলেন সনি, সেই ক্যাম্পাসেরই কিছু ‘ছাত্রের’ হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে তাকে।

২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েরই সিনিয়র এক ছাত্র ধর্ষণ করে। কিছুদিন আগে সিলেটের এমসি কলেজে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা আলোচনায় উঠে আসে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে এসব সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে, যা পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব অমানবিক ঘটনার শিকার হতে হয়েছে নারীদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমোদন পাওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯২১ সালে দেশে নারীদের জন্য উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়। পরবর্তী ১০০ বছরে সমতা সূচকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এটি নারীদের সাংবিধানিক অধিকারও। তবে দুঃখের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অনেক নারী শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে নিরাপদ মনে করেন না।

অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্টের এক সমীক্ষায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টিও উঠে এসেছে। পড়াশোনার মান নিয়ে সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীরা একই ধরনের মত দিলেও, নিরাপত্তার বিষয়ে বিশাল মত পার্থক্য দেখা গেছে। পুরুষ শিক্ষার্থীদের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, নারী শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত। ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ঝুঁকির মতো বিষয়গুলোতে দুই দলের এই বিশাল মত পার্থক্য এটি স্পষ্ট করে দেয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ নিরাপদ বোধ করার মতো পরিবেশ নারী শিক্ষার্থীদের দিতে পারেনি।

বাংলাদেশের সামাজিক রীতিনীতিতে বরাবরই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে আসছে। এর ফলে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছেন এমন নারী শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। রাজনৈতিক পেশীশক্তির উত্থান ক্যাম্পাসগুলোতে আরও আতঙ্ক বাড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই ভীতি যে শুধু শিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে, তা নয়। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।

নারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগগুলো পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি হচ্ছে তাদের পুরুষ সহপাঠী বা সিনিয়রদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিযোগ। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘ফ্রেশার’ নারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই র‌্যাগিং ও অন্যান্য হয়রানির শিকার হন। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে এমন ঘটনাও আছে, যা সভ্যতা ও নৈতিকতার ভিত নাড়িয়ে দেয়।

এমনকি পুরুষ সহপাঠীদের অস্বস্তিকর দৃষ্টি ও এ ধরনের অন্যান্য প্রবৃত্তির জন্য নারী শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের যানবাহনে পর্যন্ত একসঙ্গে চলাচল করতে চান না। এটা তো কিছুই না, আসল পরিস্থিতি আরও শোচনীয়।

নারী শিক্ষার্থীদের অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ ও লাঞ্ছনা করার অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে। যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়, তারা প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিকভাবে আশ্রিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না তাদের। এ ছাড়া, ধর্ষণ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটে। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ যেসব ব্যবস্থা নেয়, তা কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। ফলে ওই নারী ও তার পরিবারকে আরও হয়রানি সহ্য করতে হয়। অনেক সময় সামাজিক লজ্জা ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়রানির জন্য তারা আত্মহত্যাও করতে বাধ্য হন।

মেডিকেল ও স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষে মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের এক বছরের ইন্টার্নশিপ করতে হয়। এ সময়টাতে নারী ইন্টার্নরা হাসপাতালের কর্মী এবং মাঝেমাঝে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকেও হয়রানির শিকার হন। এসব ঘটনা তাদের মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এছাড়া, ক্যাম্পাসে, বিশেষ করে হলগুলোতে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হতে হয় নারী শিক্ষার্থীদের। কোটা-বিরোধী আন্দোলনের সময় শুধু মাত্র ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য নারী শিক্ষার্থীরা প্রতিপক্ষের (তারাও নারী) হামলার শিকার হন। কিন্তু দোষীদের শাস্তি দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি প্রশাসন। তাদের এমন নির্বিকার প্রতিক্রিয়া নারীর ওপর সহিংসতা ও হয়রানিকে আরও উস্কে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ছাত্রীদের জন্য ‘সান্ধ্য আইন’ আছে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সন্ধ্যার মধ্যেই তাদেরকে আবাসিক হলে ফেরার নির্দেশনা দিয়ে রাখে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল এমন অনেক ছাত্রী আছেন, যাদের টিউশন করিয়ে নিজের খরচ, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের খরচও বহন করতে হয়। সান্ধ্য আইন তাদেরকে এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের চেয়ে অনেক পেছনে ফেলে দেয়।

২০০৯ সালে হাইকোর্ট প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নরোধী কমিটি (এসএইচপিসি) গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে অগ্রগতি সামান্য।

এছাড়া, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে মাদকসেবী ও মাদক কারবারিদের আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এই মাদকাসক্তরা প্রায়ই নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি করে। তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

তদন্তের ধীর গতি, উপযুক্ত শাস্তির অভাব ইত্যাদি কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। ক্যাম্পাসগুলোতে যেভাবে রাজনীতি চলছে, তাতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি তৈরি হচ্ছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর অনেক শিক্ষার্থীই বাংলাদেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। তাদের অনেকেই নিপীড়নের শিকার হয়ে এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে নিজ দেশে ফিরে যান। তাদের এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা  বাংলাদেশের শিক্ষা আন্তর্জাতিকীকরণ প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ভেবে দেখুন, এমনও হতে পারে যে, বাংলাদেশ হয়তো কখনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু করার চেষ্টা করছে। আর তখন হয়তো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অন্য দেশের কোনো এক শিক্ষার্থীর দুঃসহ অভিজ্ঞতা।

আমাদের দেশের ১০০টির বেশি মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মিলিয়ে প্রচুর নারী শিক্ষার্থী। কারিগরি শিক্ষা ক্ষেত্রেও নারীর সংখ্যা কম নয়। এই নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পুরুষ সহপাঠী থেকে শুরু করে পুরুষ শিক্ষক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষ কর্মীদেরও বিশ্বাস করতে পারেন না এবং তাদেরকে ভয় পান। এরপরও ক্যাম্পাসে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কোনো নীতি নেই। ফলে বাবা-মায়েরাও তাদের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় থাকেন।

৫০ বছর আগে যাত্রা শুরু করার সময় বাংলাদেশ নাগরিকদের জন্য উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যে নারী শিক্ষার্থীরা শিক্ষিত হওয়ার জন্য বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে পা রেখেছেন, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু করতে হবে।

আমরা একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করতে পারি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের অসম্মান, অপমান করা থেকে শুরু করে তাদেরকে যারা গুরুতর মানসিক যন্ত্রণায় ফেলেন, তাদের বিরুদ্ধে এই দিনটিতে বিক্ষোভ মিছিল হবে। এই নিপীড়ন ও নির্যাতনের সংস্কৃতি পরিবর্তনে সম্মিলিত সামাজিক প্রচেষ্টা চালানোর সময় এখনই। আমরা যদি নারী এবং সব বাংলাদেশির জন্য একটি নিরাপদ, ইতিবাচক ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি না করতে পারি, তবে চলমান এই সামাজিক অসুস্থতা আমাদের দেশের উন্নয়নের পথে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অসার করে দেবে। মলিন করে দেবে আমাদের অর্জনের গৌরবকে।

 

আবু সুমাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট’-এ অবদান রাখতে ইচ্ছুক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
CAAB pilot licence irregularities Bangladesh

Regulator repeatedly ignored red flags

Time after time, the internal safety department of the Civil Aviation Authority of Bangladesh uncovered irregularities in pilot licencing and raised concerns about aviation safety, only to be overridden by the civil aviation’s higher authorities.

11h ago