বিশ্ববিদ্যালয়ে কী শিখতে চান ব্যবসা ও প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীরা

আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই উচ্চ মাধ্যমিকের পর স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার জন্য বিষয় হিসেবে ব্যবসা ও প্রকৌশলবিদ্যাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ভালো চাকরি ও ক্যারিয়ারের সম্ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় নবীন শিক্ষার্থীরা অনেক আশা এবং স্বপ্ন নিয়ে এই দুটি থেকে একটি বিষয় প্রাধান্য দেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের দেশের শিক্ষার পেছনে ব্যয় কম নয় এবং এসব শিক্ষার্থীরা তাদের মা-বাবার কষ্টার্জিত অর্থে পড়ালেখা করেন। অনেকে আবার নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই জোগাড় করেন। এই শিক্ষার্থীরা কী লাভবান হচ্ছেন? তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কি আগামী দিনের জন্য বড় মাপের শিল্পপতি বা উদ্ভাবক তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারছে?
অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্টের আওতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই প্রশ্ন করা হয়েছিল।
প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলছে কি না, এমন প্রশ্নের (সাতটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়) জবাবে ব্যবসা ও প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীরা গড়ে নিরপেক্ষ ছিলেন। উত্তর দেওয়ার সময় তাদের মধ্যে কোনো ধরনের উত্তেজনা বা ইতিবাচক ভাব আঁচ করা যায়নি। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্টির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বাণিজ্য ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা কিছুটা সন্তুষ্ট ছিলেন। তাদের এই সন্তুষ্টির কারণ কী?
বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টির কারণ, বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের সুযোগ, শিক্ষকদের মান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একাত্মতা। সহজ ভাষায় বললে, শিক্ষার্থীরা সেটাই পছন্দ করে, যে প্রোগ্রামগুলো ভালোভাবে কার্যকর করা হয়। অভিজ্ঞতালব্ধ, সমস্যা সমাধানমূলক, পিয়ার টু পিয়ার লার্নিং এবং চাকরির বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা। তারা সেই ধরনের বিষয়সূচি পছন্দ করেন, যেগুলোর গুরুত্ব কম নয়। তাছাড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, পাস করার জন্য শুধু মুখস্থ করার দরকার হয় না এবং সময়োপযোগী শিক্ষা তারা চান। তাদের চাহিদা থাকে, শিক্ষকরা তাদের শেখানোর ব্যাপারে যত্নবান হবেন, তারা হবেন অনুপ্রেরণার উৎস, শ্রেণীকক্ষটাকে তাদের কাছে আরও বেশি উপভোগ্য করে তোলার জন্য সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবেন এবং পুরনো নোট ঘেঁটে পড়াবেন না। এ ছাড়া তারা চান শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশ হিসেবে, সম্প্রদায়ের একটি অংশ হিসেবে সহমর্মিতা এবং আন্তরিকতার সম্পর্ক তৈরি হবে।
শিক্ষার্থীরা যখন তাদের অ্যাকাডেমিক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত, এ বিষয়গুলোর মূল্যায়নে তারা গড়পড়তা বা তারও কম সন্তুষ্ট বলে মূল্যায়ন করেছেন। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে, এই পর্যবেক্ষণ খুবই প্রাসঙ্গিক এবং এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। কারণ, চাকরি জগত খুব বেশি গতিশীল এবং বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত হয়ে পড়ছে। এই খাতে কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের জটিল বিষয়ে চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কর্মীদের কাছ থেকে অন্তর্জ্ঞান, সৃজনশীলতা এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য পূরণে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আশা করা হয়। বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষায় মনে হয় না এসব বিষয় অভিযোজিত বা সংযুক্ত করেছে, অথবা তারা কোনো আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। এর পরিবর্তে তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে, বিশেষ করে বিরক্তিকর বক্তৃতা, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের সাপ্লিমেন্ট পড়ে শুনিয়ে শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন। এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি মানবসম্পদ গড়ে তোলার পক্ষে কার্যকরী না।
প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাত্মতা এবং শিক্ষাসূচির বাস্তবায়ন ছাড়াও আরও দুটো বিষয়ে সন্তুষ্টি আছে। সেগুলো হলো- শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা। তবে তারা বিতর্কও তোলেন যে অনেক শিক্ষকই তাদের এড়িয়ে চলেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখেন না। তারা প্রশ্ন তোলেন, শিক্ষকদের যে সময়টা দেওয়ার কথা সে সময়ে তারা কী করেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার মূল্যায়নে প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীরা তাদের সন্তুষ্টির ব্যাপারটি প্রত্যেকটা বিষয়ে গড়পড়তার চেয়ে কম বলে মূল্যায়ন করেছেন।
উপরের কারণগুলো থেকে প্রকৌশলবিদ্যার কতগুলো মানদণ্ড পাওয়া যায়। জটিল তত্ত্ব থেকে শুরু করে দুর্বোধ্য সব প্রশ্নোত্তরের তাত্ত্বিক প্যাঁচ সঠিকভাবে জানতে শিক্ষার্থীদের বাস্তবিকই খুব কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তবে তারা যা শেখেন তা বাস্তবে প্রয়োগ করার সুযোগ পান না।
প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখবেন বা বুঝবেন, তা নির্ভর করে শিক্ষক বিষয়টা কতটা দক্ষতার সঙ্গে ও কার্যকরী উপায়ে তাদের বোধগম্য, প্রাসঙ্গিক, আকর্ষণীয় এবং অংশগ্রহণমূলক করে শেখাচ্ছেন তার ওপর। ফ্যাকাল্টি শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও ধারণা তৈরিতে সহায়তা করে। যখন শিক্ষক এ ধরনের চেতনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হবেন, তখন তারা তাদের পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য ভুলে সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থীই এক সময় তাদের পড়ালেখার বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এরপর নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে নিম্নমানের প্রকৌশলী হওয়ার ভয়ে অন্য কোনো খাতে নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করতে এমবিএ করেন অথবা বিসিএস পরীক্ষা দেন।
এ বিষয়ে দীর্ঘদিনের জরিপ এবং আলাপ-আলোচনার সঙ্গে আমাদের পাওয়া তথ্যগুলোর সাদৃশ্য আছে। এ থেকে এই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে- এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের উপযোগী করে গড়ে তুলতে আমাদের শিক্ষাখাতে প্রাসঙ্গিক সংস্থার দরকার। যেসব শিক্ষার্থী প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে শিখতে আসে শুধু তাদের বোঝানোর উদ্দেশ্যে না, দ্রুত বিকাশমান চতুর্থ শিল্প বিল্পবের কর্মক্ষেত্রের জন্য কিছু বিশেষ চরিত্র, বৈশিষ্ট্য এবং সঠিক দক্ষতার প্রয়োজনে সেগুলো শেখানো দরকার। মানবিক ও যান্ত্রিক উভয় দক্ষতাকেই আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্পষ্টতই উপেক্ষা করে আসছে।
তরুণরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তারা দেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ। ফলে সব দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই তাদের তৈরি করে কাজে লাগাতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে তাদের সেই যোগ্যতার পরিমাপক হলো শিক্ষা। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যা করতে পারে তা হলো- নিজেদের সংস্কার এবং আগামী দিনের জন্য দেশের তরুণদের প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, শুধু ব্যবসা ও প্রকৌশলবিদ্যায় সার্টিফিকেটধারী তৈরি না। এসব সার্টিফিকেটধারীরা কি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম? তারা কি তাদের গৌরব ফিরিয়ে এনে পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিতে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতে জাতিকে পথ নির্দেশ করতে পারবে?
অর্ণব রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট’-এ অবদান রাখতে ইচ্ছুক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments