করোনা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার গুরুত্ব পায়নি শিক্ষাখাত

চলমান করোনা মহামারির মধ্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে ডিজিটাল যন্ত্র তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জোর দাবি ছিল। তা সত্ত্বেও কোভিড জর্জরিত শিক্ষা খাতের জন্য বৃহস্পতিবারের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব প্রয়োজন উপেক্ষিতই থেকে গেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত শিক্ষা বাজেটে জিডিপির শতকরা হার ও আকার অনুসারে চলতি বাজেটের মতোই প্রায় একই রকম বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথাগত পাঠদানের বিষয়টি পুরোপুরি বন্ধ আছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো টেলিভিশন এবং অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মতো নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
এই ধরনের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলে বেশ সাফল্য এলেও ডিজিটাল যন্ত্রের অভাব ও দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগের কারণে গ্রাম এলাকায় বসবাসরত শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের শিক্ষা গ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে।
গত ২৪ মে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন মূলধারার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর জন্য ডিজিটাল যন্ত্র নিশ্চিতের দাবি জানায়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক মানজুর আহমেদ বলেন, ‘শহুরে ও গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ানক ডিজিটাল বৈষম্য আছে। আমাদের দেশে অনেক কিছু স্লোগানেই আটকে থাকে। যার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই না।’
মানজুর আহমেদের অভিমত, কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষা খাতকে যে হুমকির মুখে ফেলেছে, তা মোকাবিলার জন্য এ বছর শিক্ষা খাতে বাড়তি বরাদ্দ খুবই দরকার ছিল।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শিক্ষা খাতের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য।
এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং টেকনিক্যাল ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৮ ভাগ।
গতকাল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেটের নথি অনুসারে, বর্তমানে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ আছে ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ ভাগ।
এদিন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় জানান, মহামারির শুরু থেকে সরকার শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নির্ধারিত পাঠ্যক্রম চালু রাখতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ক্লাস শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনের পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতার ও কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমেও শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেব।’
কামাল জানান, সরকারি ও বেসরকারি-দুই খাতের জন্যই সরকার ‘ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম’ শুরু করার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেবে। যাতে নতুন গ্রাজুয়েটরা সহজেই চাকরি পেতে পারে।
ডিজিটাল বৈষম্য
শিক্ষাবিদরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী এমন একটা সময়ে বাজেটটি প্রস্তাব করেছেন যখন গ্রামীণ এলাকা ও দরিদ্র পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী মহামারির কারণে স্কুলগুলোর নেওয়া দূরশিক্ষণের সুবিধা নিতে পারছে না।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুল হায়দার জানান, তার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮০। এর মধ্যে মাত্র ১৪ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করতে পেরেছে। কারণ অন্য শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের স্মার্ট ফোন কেনার সামর্থ্য নেই। তার ওপর অনলাইন ক্লাস নেওয়ার জন্য শিক্ষকদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ যন্ত্রপাতি ছিল না।
এই শিক্ষকের মতে, ‘প্রস্তাবিত বাজেটের ক্ষেত্রে সরকারের এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।’
শিক্ষা খাতের জন্য গত বছরের মে মাসে তৈরি করা সরকারের কোভিড-১৯ রেসপন্স প্ল্যান অনুসারে, গ্রামীণ এলাকার পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে মাত্র ৪৪ শতাংশের বাড়িতে টিভি আছে। শহর এলাকায় এই হার ৭৫ শতাংশ।
একইভাবে গ্রামীণ এলাকার মাত্র ৩ শতাংশ শিশুর বাসায় কম্পিউটার আছে। দরিদ্র শ্রেণীর শিশুদের ক্ষেত্রে যা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
সরকারি এই প্রতিবেদন অনুসারে, ইন্টারনেটের আওতায় থাকা গ্রামের পাঁচ থেকে ১১ বয়সী শিশুর হার মাত্র ৩০ শতাংশ।
আর এই বয়সসীমার ৯২ শতাংশ শিশুর বাড়িতে মোবাইল ফোন থাকলেও তা সাধারণ মানের ফিচার ফোন। যাতে ইন্টারনেট সংযোগের সুযোগ থাকলেও সক্ষমতা কম।
চলতি বছরের মার্চে গ্রুপ স্পেশাল মোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের আরেক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের স্মার্টফোন আছে।
রেসপন্স প্ল্যানের তথ্য অনুসারে, ‘গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুদের কাছে পৌঁছাতে বিশেষ বিবেচনার পাশাপাশি বিকল্প কৌশলও দরকার।’
এতে আরও বলা হয়, যখন স্কুল খুলবে, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের পরিবারের পক্ষে এমন আধুনিক ও ব্যয়সাধ্য সুবিধার সংস্থান করা সম্ভব হবে না। তখন ওই শিশুরা তাদের সহপাঠীদের চেয়ে নিজেদের আরও পিছিয়ে পড়া মনে করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ক্ষেত্রেও গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা সমসাময়িক শহুরে শিক্ষার্থীদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে। কোভিড-১৯ মহামারি এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম এই সদস্য আরও বলেন, ‘শিক্ষা খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা দরকার। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। সবার জন্যই ডিজিটাল যন্ত্র ও ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। এর সবকিছুর জন্য আরও বড় শিক্ষা বাজেটের দরকার ছিল।’
অধ্যাপক সিদ্দিকুরের মতে, বেশিরভাগ শিক্ষক ডিজিটাল ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে অভ্যস্ত না। সুতরাং অনলাইন ক্লাসের জন্য তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া উচিত সরকারের। এই কারণেও বাজেটে শিক্ষাখাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন।
এমন অবস্থার মধ্যে গত ১৪ মাসে কম্পিউটারসহ খুচরা আইটি যন্ত্রাংশের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। মহামারিজনিত বিধিনিষেধের কারণে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক পরিসর দূরশিক্ষণের পাশাপাশি বাড়িতে বসে কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়েছে।
কম্পিউটার আমদানিকারক ও স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) এর জেনারেল ম্যানেজার মুজাহিদ আল বেরুনি সুজন জানান, আগে তারা একটি কোর আই থ্রি ল্যাপটপ বিক্রি করতেন ৪০ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকায়। এখন তা ৪৭ থেকে ৪৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের রায়ানস কম্পিউটারস এর মাহফিজুর রহমান বলেন, এর পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ যেমন ল্যাপটপ হার্ডডিস্ক, র্যাম স্টিক, রাউটার, মাদারবোর্ড ও প্রসেসরের দামও বেড়েছে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও আইটি ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য কর অব্যাহতির প্রস্তাব রেখেছেন।
একইসঙ্গে স্থানীয়ভাবে তৈরি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, নোটবুক, নোটপ্যাড, ট্যাব, কিবোর্ড ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর রেয়াতের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনসহ অনেক শিক্ষক এমপিওভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের দাবি জানিয়েছিলেন। কারণ তারা নিয়মিত পুরো বেতন পাচ্ছিলেন না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ছিল, দ্রুত তহবিল শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে তারা শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না। শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতনের জন্য তাদের জরুরিভিত্তিতে অর্থ দরকার।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল এসব বিষয়ে কিছুই বলেননি।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments