সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আরও ১৪ লাখ মানুষ
সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আগামী অর্থবছরের জন্য নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ও স্বল্প বেতনে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য মোট ১২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার দুটি পৃথক তহবিল গঠন করেছে।
বাজেটের নথি অনুযায়ী, এই তহবিলগুলোর একটিতে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান ও কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নিতে সাত হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আরেকটিতে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দিনমজুর, কৃষক, গৃহকর্মী এবং যারা বন্যা, ঝড়, শিলাবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের সহায়তার জন্য আরও পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে।
তবে, সরকার এখনো এই তহবিলের উপকারভোগীদের বিশদ তথ্য দেয়নি।
অর্থমন্ত্রীর বাজেটের নথিতে বলা হয়েছে, ‘উভয় কার্যক্রমের জন্য উপকারভোগীদের তালিকা প্রস্তুত করার কাজ চলছে এবং সেটি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।’
এই নতুন দুই তহবিলসহ সরকার গতকাল ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন প্রায় ১৪ লাখ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হবে। এটি মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ১১ শতাংশ বলে গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন।
এই প্রথম দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেট বরাদ্দের অর্থ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে এটি ছিল ৯৫ লাখ ৫৭৪ কোটি টাকা। তহবিলগুলো দেশের দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে ডিজাইন করা বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির প্রচার ও সম্প্রসারণের জন্য ব্যবহৃত হবে।
এর আগে, সরকার কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া সাধারণ ছুটির সময় প্রায় ৩৫ লাখ দরিদ্র পরিবার, যারা আয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তাদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করে। গত মাসে উদযাপিত ঈদুল ফিতরের আগে প্রতিটি পরিবার দুই হাজার ৫০০ টাকা এককালীন নগদ সহায়তা পেয়েছিল।
প্রায় একই সময়ে, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সরকার কালবৈশাখী ও তাপদাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধানের কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা নগদ সহায়তা পেয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা অবশ্য বলছেন যে, লক্ষ্যভিত্তিক উপকারভোগীদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়াই এখানে মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের উদাহরণ রয়েছে। যেমন: অযোগ্য ব্যক্তিদের উপকারভোগী হিসেবে বাছাই এবং অর্থ নিয়ে দুর্নীতি, যা প্রকৃত দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্তদের অনেককেই সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে।
গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম কোভিড-১৯ ঢেউ যখন আঘাত করেছিল, তখন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে সরকার আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন আছে এমন ৫০ লাখ পরিবারের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। লক্ষ্য ছিল, এক হাজার ২৫৮ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ওই পরিবারগুলোকে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা।
এসব উপকারভোগীদের মধ্যে রিকশাচালক, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, কৃষক, দোকান কর্মচারী, ছোট ব্যবসায় কর্মরত শ্রমিক ও পরিবহন শ্রমিক অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গত বছরের মে’তে অর্থ বিতরণ শুরু হওয়ার পরই উপকারভোগীদের তালিকায় অসামঞ্জস্যতার অভিযোগ পাওয়া যায়। সেখানে সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম পাওয়া গেছে এবং সরকার মাঝপথে এ সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
সব নাম ক্রস-চেক করার পরে অর্থ মন্ত্রণালয় ১৪ লাখ ৩২ লাখ নাম তালিকার থেকে বাদ দিয়ে ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার উপকারভোগীর একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে।
৩৪ লাখ ৯৭ হাজার উপকারভোগীর ওই তালিকার ভিত্তিতে এপ্রিলে সরকার এ বছর আবারও একই পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল।
সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা আরও প্রশস্ত হবে
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের লক্ষ্য ছিল দেশের আরও প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষার আওতায় আনা।
গতকাল অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীকে বেকারত্ব ও মহামারিজনিত কারণে আয়ের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে আমাদের সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোকে আরও প্রশস্ত করার ব্যবস্থা নিয়েছে।’
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাকে আরও প্রশস্ত করার জন্য কয়েকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী অর্থবছর থেকে ১৫০টি দরিদ্র প্রবণতম উপজেলায় সব দরিদ্র ও বয়স্কদের ভাতা প্রদানের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’ চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১২০টি উপজেলায় দরিদ্র ও বয়স্করা এ ভাতা পাচ্ছেন।
এতে আরও আট লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবে এবং এ লক্ষ্যে অতিরিক্ত ৪৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে।
একইভাবে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও নিঃস্ব নারীদের জন্য কভারেজ বাড়ানো হচ্ছে। এতে চার লাখ ২৫ হাজার নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবে এবং এ লক্ষ্যে অতিরিক্ত ২৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে।
উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়লেও জনপ্রতি সহায়তার পরিমাণ একই থাকছে। দুটি ক্যাটাগরিতে একইরকমভাবেই মাসে ৫০০ ও ৭৫০ টাকা অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে।
সর্বশেষ প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে দুই লাখ আট হাজার করার প্রস্তাব করেছে সরকার। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিবন্ধী ভাতায় অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত ফেব্রুয়ারির ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হবে। এজন্য এক হাজার ৯২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত সামাজিক সুরক্ষা নেট প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, বরাদ্দের প্রায় এক চতুর্থাংশ বা ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা সাত লাখ ৫৩ হাজার সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশনের জন্য ব্যয় করা হবে।
এ ছাড়াও সুদের জন্য ভর্তুকি, সুদ ছাড়, কৃষকদের জন্য পুনরায় ফিনান্সিং স্কিম ও সরকারি ব্যাংকের কর্মসংস্থান উৎপাদন কর্মসূচির জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, যার বেশিরভাগ বড় ব্যবসাগুলোতেই পৌঁছাবে।
ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং, টেস্ট রিলিফ ও কাজের বিনিময়ে খাদ্যের (কাবিখা) মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাজেট বাড়ানো হয়েছে।
বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে, সত্যিকারের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ সাধারণত সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দের একটি বড় অংশ থেকেই উপকৃত হয় না।
গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ৬৫ শতাংশ তহবিল স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও উপকারভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে যারা দরিদ্র নন তারা পেয়েছেন।
‘উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রদানের দক্ষতা’ শীর্ষক সিপিডির এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো কেবল দরিদ্র জনসংখ্যার একটি অংশের কাছেই পৌঁছাতে করতে পারে। কারণ মাত্র ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ দরিদ্র পরিবার এরকম সহায়তা পেয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি
Comments