প্রস্তাবিত বাজেট: প্রবাসীদের আশায় গুড়েবালি!

জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ শিরোনামে রেকর্ড ঘাটতির বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন তিনি।
Bangladeshi_expatriate_1.jpg
করোনায় অসহায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ছবি: স্টার

জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ শিরোনামে রেকর্ড ঘাটতির বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন তিনি। বিশাল এই বাজেট দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বেশি।

বহুল প্রত্যাশিত এই বাজেটে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক খাতে কর রেয়াত, সুযোগ-সুবিধা-প্রণোদনা বাড়ানো হলেও অনেকটা উপেক্ষিত প্রবাসীরা। রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য আশানুরূপ বরাদ্দ নেই এবারের বাজেটে। রেমিট্যান্সের ওপর দুই শতাংশ প্রণোদনা আরও বাড়ানো কিংবা প্রবাসীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য বরাদ্দ, প্রস্তাবিত বাজেটে কোনোটিরই প্রতিফলন নেই। যদিও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বিষয়ে প্রশংসা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি ২০২১-২২ অর্থবছরেও এই খাতে দুই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছেন।

অথচ শোনা গিয়েছিল, বিদ্যমান দুই শতাংশ রেমিট্যান্স প্রণোদনা বাড়িয়ে চার শতাংশ করার প্রস্তাব আসবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় থেকে তেমনই প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছিল অভিবাসন ও প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সব বেসরকারি সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেই হিসেবে আশায় বুক বেঁধেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশে থাকা প্রায় এক কোটি ৪৮ লাখ প্রবাসী। ৩ জুন সেই ঘোষণায় অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলেন তারা। করোনায় অসহায়ত্বের জন্য প্রয়োজনটাও ছিল। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি!

প্রণোদনা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে গত ২৮ এপ্রিল চিঠি দিয়েছিলেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। তার প্রস্তাবে বলা হয়, বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের ধারাটি অব্যাহত রাখতে পারলে এবং আরও বেগবান করতে পারলে রেমিট্যান্স প্রবাহের বর্তমান ধারা অদূর ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। তাই প্রবাসীদের উৎসাহী করতে বিদ্যমান দুই শতাংশের প্রণোদনা বাড়িয়ে চার শতাংশ করা যেতে পারে। এ খাতে সরকারের অতিরিক্ত চার হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এটি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

করোনার এই মহামারিতেও প্রতি মাসে বেড়েছে রেমিট্যান্স। অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত রেমিট্যান্সযোদ্ধারা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে সচল রেখেছেন অর্থনীতির চাকা। বলা হচ্ছে, করোনার মধ্যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাজনিত কারণে রপ্তানি আয় যখন নিম্নমুখী, তখন প্রবাসীদের আয় স্বস্তি দিয়েছে সরকারকে। অথচ  বিশ্বব্যাংক করোনার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবাসী আয় ২২ শতাংশ কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। বাস্তবে দেখা যায়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় প্রবাসী আয় বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে দুই হাজার ২৭৫ কোটি  কোটি ডলার। যেখানে প্রবৃদ্ধি ৪০ দশমিক এক শতাংশ। আর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলার আসে চলতি অর্থবছরের গত জুলাই মাসে। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে যখন সরকার প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে ওই বছর আসে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার, যা আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৬৪১ কোটি ডলার।

রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত রাখতে এবং গতি বাড়াতে বাজেটে প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বরাদ্দ রাখাও যৌক্তিক ছিল। কারণ, প্রবাসীদের শ্রম ও সেবার বিপরীতে চাহিদা অত্যন্ত সীমিত। এখনো বিষয়টি ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে, তাই, বৃহৎ প্রবাসী জনগোষ্ঠীর স্বার্থে রেমিট্যান্স প্রণোদনা চার শতাংশ করার জোর দাবি থাকলো।

এ ছাড়া, প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের কিছু মৌলিক দাবি ছিল সেগুলোও এবারের বাজেটে ফের উপেক্ষিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— প্রবাসফেরত কর্মীদের জন্য সরকারিভাবে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা পেনশন চালু ও প্রবাসে থাকা কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বীমা প্রকল্প। এই দুটি দাবি যৌক্তিক ও প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অধিকাংশ কর্মী জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেন প্রবাসে। কেউ কেউ ২০ থেকে ২৫ বছরেরও অধিক সময় প্রবাসে থেকে রেমিট্যান্স পাঠান। আবার ষাটোর্ধ্ব কর্মীরা ফিরে আসেন একেবারে শূন্য হাতে।

যতদিন তারা প্রবাসে থাকেন ততদিন কোনো বাড়তি চাহিদা জানান না এই প্রবাসীরা। কিন্তু শেষ সময়ে যখন তারা দেশে ফিরে আসেন তখন তাদের করার মতো আর কিছুই থাকে না। পেনশন সুবিধার আওতায় এলে এসব প্রবাসীরা শেষ সময়ে অন্তত বেঁচে থাকার ভরসা পাবেন। বিশেষ করে মৌলিক চাহিদা মেটাতে এই পেনশন সুবিধা তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে। তাই প্রবাসফেরত কর্মীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বরাদ্দে পেনশন সুবিধা চালুর বিষয়টি বিবেচনায় আনার দাবি রইলো।

অধিকাংশ প্রবাসীই স্বল্প আয়ের শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্যে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। শ্রমিকদের মৌলিক বীমাগুলো শুধু জরুরি চিকিৎসা সেবার আওতায় থাকে। এ জন্য অনেকেই শরীরের রোগ পুষে রাখেন কিংবা চিকিৎসার জন্য দেশে ফিরে আসেন। দেশেও চিকিৎসা ব্যয় সামাল দেওয়া অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যদি একটি স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা যায় তাহলে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি প্রবাসীদের মৃত্যু ঝুঁকিও কমবে।

প্রবাসে চাকরিচ্যুত ও আহত কর্মীদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে আইনি সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। কারণ প্রতিবছর অসংখ্য প্রবাসী কর্মী এমন সমস্যায় পড়েন। বিশেষ করে দেশের বাইরে আইনি লড়াই করা ব্যয়বহুল ব্যাপার। যে কারণে ভুক্তভোগী রা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হন, শূন্য হাতে দেশে ফেরেন। এখন প্রতিবছর যে ক’টি মামলার নিষ্পত্তি হয়, সেগুলোতেও কয়েক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পান প্রবাসী, যা রেমিট্যান্স হিসেবেই যোগ হয় সরকারের খাতায়। সবাই আইনি সহায়তা পেলে ক্ষতিপূরণ আদায় অনেকগুণ বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে।

এর বাইরেও প্রবাসীদের আরও কিছু দাবি কালক্রমে সামনে এসেছে, বাজেটে যার বরাদ্দ আশা করেন প্রবাসীরা। যেমন, স্বল্প আয়ের প্রবাসীদের জন্যে বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প চালু, চলমান আয়কর আইন সংশোধন করে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর পরিবারের সদস্যদের আয়কর ও প্রবাসীদের অবসরকালীন সঞ্চয়ের ওপর আয়কর মাফ, প্রবাসী কর্মীদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম চালু।

প্রবাসীদের শ্রম ও সেবার বিপরীতে চাহিদা অত্যন্ত সীমিত। রেমিট্যান্সের বর্তমান প্রবাহ ধরে রাখতে এবং গতি বাড়াতে বাজেটে প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বরাদ্দ রাখাও যৌক্তিক ছিল। প্রবাসীদের বৃহৎ স্বার্থের বিষয়গুলো ভেবে দেখা হবে বলে আশা রাখছি।

কামরুল হাসান জনি, প্রবাসী সাংবাদিক ও যুগ্ম সম্পাদক বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব, সংযুক্ত আরব আমিরাত

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Army given magistracy power

In order to improve law and order, the government last night gave the power of magistracy to commissioned army officers for 60 days.

2h ago