বাজেটে নেই মধ্যবিত্ত
গত মাসের একটি ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের ফরিদ আহমেদ ত্রাণ চেয়ে জাতীয় হটলাইন ৩৩৩-এ ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু, তাকে ‘বেশ ধনী’ মনে করে সরকারি সহায়তা পাওয়ার ‘উপযুক্ত নন’ বলে গণ্য করা হয়। ঘটনাটি সারা দেশে বেশ আলোড়ন ফেলে।
ফরিদের পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড়, সাত ভাই বোনের জন্য বাবার রেখে যাওয়া চার তলা বাড়ি দেখে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনে করলেন ফরিদ ত্রাণ পাওয়ার উপযুক্ত নন, সরকারকে ফাঁকি দিয়ে ত্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এ অপরাধে ফরিদকে শাস্তি হিসেবে এক শ লোককে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়। মাসে মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতন পান তিনি। ইউএনওর আদেশ পালন করতে এবং কারাভোগ এড়াতে ৬৫ হাজার টাকা ধার করলেন ফরিদ।
অপমানে অপদস্ত হয়ে দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় বছরে যখন শ্রমবাজার ছোট হয়ে গেছে, দেশের লাখ লাখ পরিবারের গল্পগুলো প্রায় এরকমই।
তবুও, ‘ধনী’ ও ‘দরিদ্র’ কোনোটাই হতে না পারা ‘মধ্যবিত্ত’কে গত বছরের মতো এবারও বাজেটে বিবেচনায় রাখা হয়নি।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে গত বছরের বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ ৭ হাজার ৬৪১ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘চরম দরিদ্র’ শ্রেণির আওতায় পড়ে না এমন ছোট শ্রেণির জন্য এ অর্থ বরাদ্দ হবে।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেতনভোগী কর্মীদের আয় ৪৯ শতাংশ কমে গেছে। তবুও এখানে বেকারত্বের সুবিধা এখনও হাজার মাইল দূরের ভাবনা।
বেকারদের জন্য বাজেটে একমাত্র ‘মহামারিজনিত কারণে দেশব্যাপী হঠাৎ বেকারত্ব ও আয় হারানো তালিকাভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারগুলোর’ জন্য সরাসরি এককালীন নগদ আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এবার আরেকটি গল্প। চলচ্চিত্রে প্রযোজনা পরিচালক হিসেবে কাজ করেন সোয়েব ইসলাম স্বাধীন। করোনার কারণে গত বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি কর্মহীন ছিলেন। সে সময় তাকে ঋণ করে পরিবার চালাতে হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরখানে এক বেডরুমের এক বাসায় তার এক ভাইয়ের সঙ্গে তিনি থাকেন। শুটিং থাকলে দৈনিক ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা আয় তার।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাকে কোনো কাজ ছাড়াই কয়েক মাস কাটাতে হয়েছে। আমি শুটিং হলে টাকা পাই। সে সময় শুটিংও ছিল না, তাই কোনো রোজগারও হয়নি। কাজের আশায় নওগাঁয় বাড়িতেও ফিরে যাইনি।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত এপ্রিলে জানায়, দেশের মোট নিয়োগপ্রাপ্ত জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশের কাছে সংকটকালীন প্রণোদনার টাকা পৌঁছেছে। এ বছরও গ্রামাঞ্চলের তরুণদের ব্যবসায় সহযোগিতার জন্য ক্ষুদ্র ঋণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে, স্বাধীনের মতো যাদের পেশা, তাদের জন্য নেই কিছুই।
এদিকে, চলতি বছর একটি বর্ধিত স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে ৮০ হাজার পরিবারকে প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকার বিমার আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু, এটিও কেবল দারিদ্র্যসীমার নিচে যাদের অবস্থান, তাদের জন্য।
এর মধ্যে, করোনা চিকিৎসা করাতে গিয়ে মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ বছরের শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনোমিকস ইউনিট (এইচইইউ) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে একজনের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে।
এ ছাড়া, গত বছর করোনা সংকটে বাসা ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়াটেদের উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। এর উল্লেখ করে ভাড়াটিয়া ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি মোহাম্মদ কমল গাজী ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ বছর আমরা ছোট ফ্ল্যাট এবং ঋণের ক্ষেত্রে কর ছাড়ের দাবি জানিয়েছিলাম।’
যদিও প্রস্তাবিত বাজেটে ‘ঢাকা মহানগরীর আবাসন সমস্যা সমাধানে পূর্বাচল এবং উত্তরা-১৮ তে প্রায় ৭০ হাজার নতুন ফ্ল্যাট’ নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবুও, মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে নিজের একটি বাসস্থান থাকার স্বপ্ন অধরা।
তবে, নিজের বাড়ি না হলেও, বাড়ির ভেতরে ব্যবহারের জন্য ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, বৈদ্যুতিক ওভেন, ব্লেন্ডার, মিক্সার, বৈদ্যুতিক কেতলি, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার, প্রেসার কুকারের দাম কমানোর প্রস্তাব এসেছে বাজেটে। দেশে উৎপাদিত এসব পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন শরীফ এম শফিক
Comments