উপেক্ষিত কর্মহীন ও এসএমই খাত

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতকে পুনরায় সচল করতে সরাসরি কোনো নগদ প্রণোদনার প্রস্তাব আসেনি। এ খাত সংশ্লিষ্ট লাখো লোক কাজ হারালেও, বাজেটে সরকার কেবল স্বল্প আকারে কিছু কর মওকুফের প্রস্তাব করেছে।

বরং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ সালের বাজেট প্রস্তাবনায় এ খাতে এর আগের এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন।

গত বছর করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে সিএমএসএমই ও অনানুষ্ঠানিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, এ খাতগুলোতে আগের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো খুব একটা কাজে লাগেনি।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ খাতের ওপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপে দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশই ততদিনে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাবেক উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মহামারির আগের ৩০ লাখ বেকার যোগ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে দেশের প্রায় এক কোটি ৩৫ লাখ লোক গত বছর কর্মহীন হয়েছেন, যা দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক পঞ্চমাংশ।’

এর মধ্যে বেশিরভাগ লোক কাজ হারিয়েছেন এই এসএমই খাতেই। এ ছাড়া, গত বছর বিদেশে চাকরি হারিয়ে প্রায় চার লাখ  অভিবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন।

চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) দেশের তিন হাজার ৩৪৮টি পরিবারের ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, দেশের ভেতরে অন্য এলাকায় গিয়ে কাজ করা অন্তত ৪৯ শতাংশ মহামারির কারণে গত বছরের মার্চ-ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন, বেতন পাননি কিংবা বেতন কমেছে।

করোনার কারণে আত্মকর্মসংস্থান করা প্রায় ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করা ৩৪ দশমিক দুই শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা আগের আয়ে ফিরতে পারেননি।

বিদেশে গত বছর কাজ করতে গেছে দুই লাখ ১৭ হাজার জন। যেখানে তার আগের বছর সাত লাখ লোক গিয়েছিল। এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ৮৫ হাজার বাংলাদেশি বিদেশে যেতে পেরেছেন। তবে, পরে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে বেশিরভাগ দেশ ফ্লাইট পরিচালনা ও শ্রমিক নিয়োগ স্থগিত করে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে দেশে আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ নতুন দরিদ্র হয়েছে এবং এজন্য আগামী অর্থবছরে অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমে থাকা উচিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

নগদ প্রণোদনার কথা উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ব্যবসা ফিরিয়ে আনতে এবং লাখো মানুষের চাকরি ধরে রাখতে এসএমই খাতের মালিকদের হাতে নগদ টাকা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ের কাঁচামাল কিনতে বা আমদানি করতে সহায়তা করবে। কিন্তু, ব্যবসা ফিরিয়ে আনতে এবং কর্মী ধরে রাখতে ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে চাইলে সরাসরি নগদ সহায়তা বা প্রণোদনা লাগবে।’

সিএমএসএমই খাতে সরকারের কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত প্রণোদনা প্যাকেজ বরাদ্দ করা উচিত বলে গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন। তিনি বলেন, ৫০ হাজার কোটি টাকার ৩০ শতাংশ রাখা উচিত নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য।

প্রণোদনা হিসেবে সরকার কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এ পর্যন্ত ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যার ৭২ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে।

এসএমই মালিকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক কোটিরও বেশি উদ্যোক্তার ১৫ শতাংশ উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রায় অর্ধেক টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।

অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকটের মুখে বেকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় অবকাঠামোতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো একটি বহুল স্বীকৃত উপায়। তবে, অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছোট আকারের স্কিমগুলোতে। যেগুলো অল্প সময়ের পরিকল্পনায় শেষ করা যায়। এতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়।’

সিপিডির সম্মানিত ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনেকে সেবা ও উত্পাদনমুখী খাত থেকে কৃষিতে চলে এসেছে। কিন্তু, এখানেও আয় কমেছে। এখন পর্যন্ত তারা ভালোভাবে উপার্জনের মুখ দেখতে পারছেন না।’

জিডিপিতে অভ্যন্তরীণ খাতের অবদান ৮৪ শতাংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার সাধারণত রপ্তানি শিল্পে ভর্তুকি দেয়। তবে, এ সময়ে আমদানির বিকল্প হিসেবে যেসব শিল্প গড়ে উঠেছে সেগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া উচিত।’

‘সামগ্রিকভাবে, ব্যবসার আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সবার জন্য উন্নত করা উচিত’, যোগ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ কমে আসলে গত বছরের শেষ দিকে অনেকে আবার চাকরি ফিরে পেতে শুরু করে। কিন্তু, এ বছরের মার্চের প্রথমে লকডাউন শুরু হলে মানুষ আবার কাজ হারাতে থাকে।’

মেগা প্রকল্পের গতি বাড়িয়ে কর্মসংস্থান তৈরির প্রস্তাবের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্তত পাঁচটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এসএমই খাতে বরাদ্দ করা প্রণোদনার অর্থ সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে এনজিওর মাধ্যমে অর্থ ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ।

এ ছাড়া, ই-কমার্স খাতের বিকাশের জন্য তিনি কর আরোপের পরিবর্তে প্রণোদনা, প্রযুক্তিগত সহায়তা, কর মওকুফ ছাড় ও ইন্টারনেট খরচ কমানোর সুপারিশ করেছেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান পোশাক খাতে ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এক হাজার কোটি টাকার বিশেষ স্বল্প ব্যয় তহবিলের দাবি করেছেন।

তিনি বলেন, ‘তহবিলের একটি অংশ বন্ধ কারখানাগুলো আবার চালু করতে কাজে লাগানো যেতে পারে। বাকি অংশ বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মালিক এবং যারা কারখানা চালাতে পারছেন না তাদের ঋণ পরিশোধে কাজে আসতে পারে।’

বাংলাদেশ এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান এসএমই খাতের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো প্রণোদনা সহায়তার দাবি করেছেন। এ ছাড়া এ খাতকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।

প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকর ব্যবস্থাপনা এবং ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগগুলোর টিকে থাকা নিশ্চিতে প্রতিযোগিতা আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের দাবিও জানান তিনি।

এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মাসুদুর রহমানের মতে, উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থানের প্রায় ৯০ শতাংশ এবং সেবা খাতে কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ সিএমএসএমইর মাধ্যমে তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘উন্নত অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য তহবিলের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে আমাদের আনুষ্ঠানিক খাতগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক খাতের সংযোগ ঘটাতে হবে।’

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘বিদেশে চাকরির ক্ষেত্র বাড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সুশাসন নিশ্চিত করা এবং চাহিদাভিত্তিক দক্ষতা বাড়ানো।’

তিনি বলেন, ‘সারাবিশ্বে বেশ ভালো চাহিদা থাকায় দীর্ঘদিন ধরে আমরা আরও নার্স, কেয়ারগিভার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট তৈরির পক্ষে পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু, এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি।’

উন্নত দেশগুলোতে যেতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

এ মুহূর্তে অভিবাসীরা যেন বিদেশে সহজে চাকরি পেতে পারে, সেজন্য তাদের শিগগির করোনার টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন শরীফ এম শফিক

Comments

The Daily Star  | English

Election in first half of April 2026

In his address to the nation, CA says EC will later provide detailed roadmap

42m ago