ইসরায়েলের সামরিক ক্ষমতার বৃত্তান্ত

ইসরায়েল গত মাসে গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করেছে, যেটি গত ১২ বছরে তাদের চতুর্থ আক্রমণ। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করার চুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছে। ইসরায়েলের ১১ দিনব্যাপী সামরিক অভিযানে অন্তত ২৫৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬৬ জন শিশু।

ইসরায়েল গত মাসে গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করেছে, যেটি গত ১২ বছরে তাদের চতুর্থ আক্রমণ। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করার চুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছে। ইসরায়েলের ১১ দিনব্যাপী সামরিক অভিযানে অন্তত ২৫৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬৬ জন শিশু।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা আজ শুক্রবার একটি ইনফোগ্রাফিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ইসরায়েলের ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সী সব নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং সামরিক বাহিনীর কাজে নিয়োজিত হতে হয়।

স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) এক ডেটাবেজ অনুযায়ী, ইসরায়েল ২০২০ সালে সামরিক খাতে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। এই খাতে তাদের মাথাপিছু খরচ দুই হাজার ৫০৮ ডলার এবং তারা বাজেটের প্রায় ১২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ইসরায়েলের সামরিক খাতে ব্যয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক শক্তিগুলো, যেমন: নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করার মতো।

ইসরায়েল বিশ্বের অন্যতম প্রধান আধুনিক অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। তারা ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডার প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে রপ্তানি করে থাকে। ২০২০ সালে ইসরায়েল বিশ্বের ১২তম বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ১৬টি দেশে প্রায় ৩৪৫ মিলিয়ন মূল্যের অস্ত্র রপ্তানি করেছে, জানায় এসআইপিআরআই’র ডেটাবেজ।

ইসরায়েলকে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ তিন দশমিক আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই অস্ত্রগুলো ২০১৬ সালে ওবামা প্রশাসনের আমলে করা ৩৮ বিলিয়ন ডলারের দশ বছরব্যাপী চুক্তির অংশ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর ২০০৭ সাল থেকে অর্থনৈতিক সহায়তার পরিবর্তে সামরিক সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

অপরদিকে, ফিলিস্তিনকে ২০২০ সালে সব ধরণের খাত মিলিয়ে মাত্র ১৯ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। তবে, বিভিন্ন অনুদান প্রক্রিয়াকে তথাকথিত ‘শান্তি পরিকল্পনার’ অজুহাত দেখিয়ে স্থগিত করে দিয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার।

১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যাবত তাদেরকে সর্বমোট পাঁচ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। তবে, এ সহায়তাগুলো কীভাবে ব্যবহার করা যাবে, তা নানা ধরনের নীতিমালা ও বিধিনিষেধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাইডেন প্রশাসন উল্লেখ করেছে যে, তারা ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, তবে তার পরিমাণ ইসরায়েলকে দেওয়া সহায়তার একটি ক্ষুদ্র অংশের সমান হবে।

১৯৬৭ সালে ছয় দিনব্যাপী আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সামরিক সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। বর্তমানে মার্কিন সহায়তার প্রায় ৮০ শতাংশই সামরিক খাতে দেওয়া হয়।

এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, ডেমোক্রেট কিংবা রিপাবলিকান, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু ভাবাপন্ন মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসেনি এবং ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে একের পর এক সামরিক অভিযান চালাতে থাকলেও তাদের প্রতি সামরিক সহায়তায় কোনো ভাটা পড়েনি। ২০০৮-২০০৯, ২০১২ এবং ২০১৪ সালের আক্রমণে অন্তত তিন হাজার ৫০০ জন ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অপরদিকে, এ তিন যুদ্ধ মিলিয়ে মাত্র ১০০ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হন।

২০০৩ সালের পর থেকে ইসরায়েলে হঠাৎ করে মার্কিন সামরিক সহায়তার পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সানফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্টিফেন জিউনস বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ব্যয় এবং অস্ত্রের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ২০০১ সালে আল-কায়েদার আক্রমণ এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন সেনা মোতায়েনের ঘটনাগুলো দায়ী।’

তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন অনুদানের পরিমাণ কখনোই তাদের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল না, বরং তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত লক্ষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।’

মার্কিন সরকারের একটি বিশেষ প্রকল্প হচ্ছে ‘ফরেন মিলিটারি ফাইন্যান্সিং’ বা এফএমএফ। এর মাধ্যমে বিদেশি রাষ্ট্র (মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা) মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষামূলক বিভিন্ন রকমের যন্ত্র, সেবা ও প্রশিক্ষণ ক্রয় করার জন্য অনুদান ও ঋণ পেয়ে থাকে। গত দুই দশকে এফএমএফ প্রকল্পের আওতায় দেওয়া অর্থের ৫৫ শতাংশ ইসরায়েল পেয়েছে, যা বাকি বিশ্বের সব দেশের সমষ্টিগত পরিমাণের চেয়েও বেশি, জানিয়েছে সিকিউরিটি এসিস্ট্যান্স মনিটর, এটি ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির একটি অঙ্গসংগঠন।

সরাসরি সহায়তা ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের সামরিক সহায়তা পেয়ে থাকে ইসরায়েল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ‘জরুরি অস্ত্র’ হিসেবে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র মজুদ রেখেছে ইসরায়েলে, যার বর্তমান মূল্য প্রায় তিন দশমিক চার বিলিয়ন ডলার। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রয়োজন সাপেক্ষে এসব অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়াতেও এ ধরনের অস্ত্র মজুদ আছে। এ ব্যবস্থাগুলো করা হয়েছিল যাতে হঠাৎ প্রয়োজন দেখা দিলে এসব রাষ্ট্রে দ্রুত মার্কিন সেনা মোতায়েন করা যায়। তবে, ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এ বাড়তি অস্ত্রের মজুদটি একটি অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে এবং যেকোনো সংঘর্ষের সময় অস্ত্র ও গোলাবারুদের সহজ উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ইসরায়েলের সামরিক খাতে আমদানি ও রপ্তানি

ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানি, রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু, গত এক দশক ধরে এই অনুপাতটি সম্পূর্ণ উল্টে গেছে, জানিয়েছে এসআইপিআরআই’র ডেটাবেজ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল তার প্রতিবেশী ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়াকে তাদের উদ্ভাবনকৃত নতুন সামরিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার প্রদর্শনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিভ গর্ডন বলেন, ‘এটি তাদের অস্ত্র রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অস্ত্র ও নজরদারি যন্ত্রের উৎপাদকরা এক্ষেত্রে দাবি করতে পারেন যে, তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তাদের উপযোগিতার প্রমাণ দিয়েছে।’

ইসরায়েল শুধু পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো থেকেই অস্ত্র আমদানি করে এবং ১৯৫০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আমদানিকৃত অস্ত্রের ৮৩ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

১৯৭৫ সালে ইসরায়েল একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের কাছেও অস্ত্র বিক্রি করেছিল, যা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।

২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইসরায়েলের প্রধান অস্ত্র রপ্তানি বাজারগুলো হচ্ছে- ভারত (৪৩ শতাংশ), আজারবাইজান (১৬ শতাংশ), ভিয়েতনাম (১০ শতাংশ) এবং যুক্তরাষ্ট্র (৪ শতাংশ)। এসআইপিআরআই’র ডেটাবেজ অনুযায়ী, ইসরায়েলের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভারত।

২০১৪ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে।

‘একটি ডলারও নয়’, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহ্বান

ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিন সমর্থক মানবাধিকার সংঘগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করার দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের মতে, বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা স্থাপনের মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখল করে রাখতে পেরেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অনুরোধ করেছে ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তির অনুমোদনকে পুনর্বিবেচনা করতে।

প্রগতিশীল মার্কিন সংসদ সদস্যরাও বাইডেন প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলকে দেওয়া অনুদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য। মার্কিন কংগ্রেস সদস্য বেটি ম্যাককলাম একটি বিল উত্থাপন করেছেন, যার মাধ্যমে ইসরায়েলকে মার্কিন অনুদান ব্যবহার করে ফিলিস্তিনি শিশুদের আটকে রাখা, ফিলিস্তিনি সম্পত্তি ধ্বংস করা এবং ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখল করা থেকে প্রতিহত করা যাবে।

তিনি এ মাসের শুরুর দিকে আল-জাজিরাকে বলেন, ‘মার্কিন করদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া আর একটি ডলারও ইসরায়েলের জোর করে দখল করা ভূমিতে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যবহার করা উচিত হবে না।’  

Comments